শামীম আহমেদ: রাজধানীতে মানসম্মত গণপরিবহনের সংকটের কারণে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। মধ্যম আয়ের মানুষও ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে রাজধানীতে বাড়ছে যানজট। আর যানজটের কারণে প্রতিদিন ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। তাই রাজধানীর ওপর চাপ কমাতে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার পরামর্শ দিয়েছে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত সরকারি টাস্কফোর্স। ঢাকায় সড়ক ব্যবহারে মাশুল ধার্য ও সহজ শর্তে গাড়ি কেনার ঋণ দেয়া নিরুৎসাহিত করতে টাস্কফোর্সের এক প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৫০১টি। ২০২৫ সালের মার্চ শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ৩৭ হাজার ৯৮৯। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে রাজধানীর রাস্তায় মোটরযান নেমেছে ১৬ লাখ ৬২ হাজার ৪৮৮টি। এ সময় সড়কে নামা মোটরযানের মধ্যে বাইকের সংখ্যা ৯ লাখ ৯৮ হাজার ৭৩২টি ও প্রাইভেট কার বেড়েছে এক লাখ ৯০ হাজার ৭১৪টি। অথচ গত ১৫ বছরে মাত্র ২৭ হাজার ৯৩৪টি বাস ও এক হাজার ৯৫৭টি মিনিবাস বেড়েছে। এটি হিসাবে নিলে ১৫ বছরে ঢাকায় নামা গণপরিবহনের সংখ্যা ২৯ হাজার ৮৯১টি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারের অপরিকল্পিত উদ্যোগের কারণে যানজট বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১৫ বছর নানাভাবে গণপরিবহন ব্যবস্থার বিকাশকে অনুৎসাহিত করা হয়েছে। বরং পরিকল্পিতভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ানোর নানা উদ্যোগে যানজট বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কাজ করে গেছে। এ ছাড়া ঢাকা শহরের যানজটের অন্যতম কারণ বাইক ও প্রাইভেট কার। এসবে সরকারের কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় এগুলোর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে যানজট কমাতে গণপরিবহন হিসেবে বাস-মিনিবাস গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেগুলো রাস্তায় নামানোর ক্ষেত্রেও নানা বিধি-নিষেধ রয়েছে। তাই ইচ্ছা করলেই যে কেউ ঢাকায় বাস-মিনিবাস নামানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে আইন করে নতুন সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ট্যাক্সি রাস্তায় নামানোর প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক সামছুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, আমাদের এখানে যে উন্নয়ন হয়েছে বা হচ্ছে, তা ‘খণ্ডিত উন্নয়ন’। এজন্য লাখো কোটি টাকা খরচ করেও সুফল মিলছে না। আমরা যে প্রস্তাব দিয়েছি, তা সামগ্রিক উন্নয়ন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এগুলো বাস্তবায়ন করে উপকৃত হয়েছে। তাছাড়া সড়ক, রেল, নৌ ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়কে এক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আলাদা আলাদা মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিজেদের মতো করে উন্নয়ন প্রকল্প নেয়। এতে সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো খাতে যে সংস্কারগুলো তারা প্রস্তাব করেছেন, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে শক্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। আর যদি আমলাতন্ত্রের চাপে সংস্কার না করা হয়, ভবিষ্যতে কোনো উন্নয়নই সেভাবে কাজে লাগবে না।
বিআরটিএর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকার ১১০টি রুটের জন্য বাস-মিনিবাসের অনুমোদিত সীমা সাত হাজার ৪৩টি। এছাড়া পাঁচ হাজার সিএনজি অটোরিকশা ও তিন হাজার টেক্সিক্যাবের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। মূলত ১৫ বছরের গাড়ির আয়ুষ্কাল শেষ হলে তা এ সংখ্যার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়।
যদিও সড়ক পরিবহন আইনের মাধ্যমে গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার বিআরটিএ’র। এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন আইনে বলা হয়েছে, ‘সরকার বা সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে কর্তৃপক্ষ জনস্বার্থে সমগ্র বাংলাদেশ বা যে কোনো এলাকার জন্য যে কোনো ধরনের মোটরযানের সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারবে। কোনো এলাকায় মোটরযানের সংখ্যা নির্ধারিত সংখ্যার বেশি হলে অতিরিক্ত মোটরযান অন্যত্র চলাচলের অনুমতি দেওয়া যাবে।’ আইনের যে কোনো ধরনের মোটরযানের সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষমতা বিআরটিএ’কে দেয়া হলেও তারা শুধু গণপরিবহন সংখ্যা নির্ধারণ করেছে। ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে তাদের কোনো বিধিনিষেধ নেই।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন এ বিষয়ে শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি ঢাকায় গাড়িসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। এ বিষয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করব।
এদিকে বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে গত বছরে ১০ সেপ্টেম্বর টাস্কফোর্স গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ৩০ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের ‘অবকাঠামো ও সংযোগ: অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ’ শীর্ষক অংশটি করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক।
প্রতিবেদনে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে এখনই উড়ালসড়ক নির্মাণ বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। বাস, ট্রেনসহ গণপরিবহনে জোর দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অবশ্য চাষযোগ্য জমি বাঁচাতে শহরের বাইরে উড়ালসড়ক ও উড়াল রেলপথ নির্মাণের কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার সুপারিশ করা হয়। এজন্য রাজধানীতে কত গাড়ি চলতে পারবে, সেই সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়ার কথা বলা হয়। গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য যেমন টাকা ব্যয় করতে হয়, তেমনি সড়ক ব্যবহারে গাড়ির জন্য মাশুল ধার্য করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে গাড়ি কেনার ঋণ কমিয়ে আনা এবং গাড়ির অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য জরিমানা বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয়।
সরকারের প্রকল্পের অধীন যাতে বিলাসবহুল গাড়ি কেনা না হয়, সে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। রাইড শেয়ারিং সেবার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জোর দেয়া হয়েছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা, লেগুনা, দুরন্তর মতো যানের চলাচল বন্ধের পরামর্শ দিয়ে বড় ও দ্বিতল বাস বাড়ানোর কথা বলেছে টাস্কফোর্স কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এতে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ, ট্রাম, বিআরটি (বাস র?্যাপিড ট্রানজিট), এলআরটি (লাইট রেল ট্রানজিট), মনোরেল, সাব আরবান কমিউটার রেল, মেট্রোরেল ও রাইড শেয়ারিংয়ের মতো সব ধরনের পরিবহনব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।