আপনজনকে ভালো রাখতে না পারার ব্যর্থতা!

মোহাম্মদ আবু নোমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর, সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে চাকরি, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক, ৩৬তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার ও ৩৭তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার, সর্বশেষ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর র‍্যাবে এএসপি হিসেবে কর্মরত। সাফল্য, ক্যারিয়ার, প্রতিষ্ঠিত জীবন, সম্মানজনক পেশা। এটি একজন মেধাবী, সুদর্শন, কর্মঠ ও আদর্শবান, উচ্চপদস্থ ট্যালেন্ট কর্মকর্তার আকাশ ছোঁয়া ঈর্ষণীয় সাফল্যের গল্প। কিন্তু সে গল্পের শেষটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক, হƒদয়বিদারক ও অপ্রত্যাশিতের সঙ্গে সমাজের জন্য এক গভীর বার্তা বহনকারী। অন্যভাবে বলতে গেলে এটি গল্প নয়, এটি একটি সামাজিক বাস্তবতা, যা হাজারও পরিবারের অপ্রকাশিত গল্প। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে যিনি ছিলেন সফল, গর্বের প্রতীক; কিন্তু তার ভেতরে ছিল ভয়ানক একাকীত্ব, অসহায়ত্ব, হতাশা! পুরুষ মানুষ গায়ে গতরে পরিশ্রম সইতে পারে, যুদ্ধের ময়দানে বুক চিতিয়ে লড়াই করতে পারে, কিন্তু পারিবারিক কলহে সে একদম ভঙ্গুর, আপনজনের দেয়া কষ্টের কাছে সে বরাবরই নাজেহাল!

র‌্যাব-৭ এ কর্মরত সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার পলাশ সাহা চট্টগ্রাম র‌্যাব কার্যালয়ের নিজ কক্ষে, নিজের পিস্তল দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন।

উচ্চশিক্ষা+বিসিএস ক্যাডার+ সুন্দরী স্ত্রী+স্বর্ণ+সাফল্য+প্রমোশন+টাকা= ০০! মানুষ আসলে মানুষকে ভালোবাসে না, ভালোবাসে তার সাফল্যের আলোকচ্ছটা, তার নামের পেছনে জ্বলজ্বলে পরিচয়ের ছায়া। প্রেম নয়, সে যেন এক ধরনের আরাম খোঁজা, যেখানে থাকে ব্যাপক সুবিধার ঘ্রাণ। পলাশ সাহা রেখে গেছেন একটি চিরকুট- যাতে লেখা চরম বেদনাহত বাক্য ‘কাউকে ভালো রাখতে পারলাম না’। এ কয়েকটি বাক্যেই যেন প্রকাশ পেল পুরুষের পারিবারিক জীবনের গভীর দহন, অন্তর্জ্বালা, দায়িত্বের চাপে পিষ্ট এক হাহাকার ও হাজারও না বলা কথার বহিঃপ্রকাশ। পুরুষ সব জয় করার পরও পরিবারের কাছে অসহায়ভাবে হেরে যায়! বাইরের সাফল্যের চাকচিক্যের আড়ালে চাপা পড়ে থাকা এক যন্ত্রণার দীর্ঘশ্বাস। একটা মানুষ কি ধরনের পরিস্থিতির শিকার হলে এমন একটি চিরকুট লিখে নিজের জীবন নিজে শেষ করে দেয়? কোনো ‘মা’ অথবা ‘স্ত্রী’ না বুঝলেও অন্তত প্রতিটি পুরুষ এটা ঠিকই বুঝবে।

আহ্ জীবন! জীবনের সব পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেও পারিবারিক পরীক্ষায় ফেল করে পরপারে চলে যেতে হলো পলাশ সাহাকে। এমন এক সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে দরকার তিলেতিলে শত শত রাত জাগা, শত চেষ্টা, শত পড়ালেখা, শত প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আর এসব আয়োজন, সব স্বপ্ন, সাধ, বাসনা, আকাক্সক্ষা, সব সাজানো রাজ্য ধ্বংস করে দিতে কত কষ্ট, বুকে কত বেদনার পাহাড়, কতটা যন্ত্রণার বিষে বিদ্ধ হয়েছিলেন এএসপি পলাশ সাহা? কতটা…? যা থেকে মৃত্যুও এতটা সহজ হয়ে যায়?

পলাশ সাহার মৃত্যুর পর তার মেজো ভাই গণমাধ্যমে যেভাবে বলেছেন তা আমাদের একটি বড় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়। তিনি জানান, ‘পলাশের স্ত্রীর সঙ্গে তার দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক কলহ চলছিল। স্ত্রী সুস্মিতা সাহা প্রায়শই পলাশের মাকে নিয়ে বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন, মা ও ভাইয়ের গায়ে হাত তুলেছিলেন পলাশ সাহার স্ত্রী। হাত তোলার এমন ঘটনা মেনে নিতে না পেরে দুপুরেই চট্টগ্রামে ‘আত্মহত্যা’র পথ বেছে নিয়েছেন তার ভাই।’

আমাদের সমাজের অনেক ঘরের চিত্র এটি। অনেকে হয়তো নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন, আর অনেকে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নিচ্ছেন। মায়ের কথা রাখতে গেলে বউয়ের কাছে খারাপ, আবার বউয়ের মন রাখতে গেলে মায়ের কাছে খারাপ। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। বউ-শাশুড়ি যেন একে আরেকজনের প্রতিদ্বন্দ্বী। যার পরিণতিতে চরম মানসিক চাপে পড়ে পুরুষ মানুষটি। পরিবারের মানুষগুলো কখনও বুঝতে চায় না, যারা চাকরিজীবী তাদের তো রাজনৈতিক, সামাজিক, অনুসন্ধানী ও জটিল ক্রাইমসহ ডিপার্টমেন্ট ট্যাকেল দিতে গিয়ে লড়াই করতে হয়, মানসিক চাপে থাকতে হয়। বাসায় এসে তাকে মানসিকভাবে ফ্রেস হতে হবে, নতুন করে কাজের এনার্জি লোড করে আবার কর্মস্থলে যেতে হবে। কিন্তু কর্মস্থলের বাইরে পরিবারের মধ্যেও বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে হেরে যাওয়া এএসপি পলাশ শাহা এক জ্বলন্ত উদাহরণ।

একজন পুরুষ পরিবারের সবার চাহিদা পূরণে আপ্রাণ চেষ্টা করেন, কিন্তু যখনই একটু কম পড়ে তখন বউ-মা, ভাই-বোন, নানা কথা বলে শান্ত মানুষটিকে অশান্ত করে দেয়। পুরুষ সহজেই কাঁদে না, ভেঙে পড়ে না; কিন্তু যখন কাঁদে শত সান্ত্বনা দিয়েও তার কান্না ফেরানো কঠিন। তাই ভাই, বোন, বউ, ভাবি, মা, অল্পতে সন্তুষ্ট থাকুন। সবাই যদি সংসার জীবনে ছাড় দিয়ে চলেন, তাহলে একটি সংসার সুন্দর এবং সুখের হয়ে ওঠতে পারে। মানসিক শান্তির থেকে বড় পাওয়া জীবনে আর কিছুই নেই। যেখানে মানসিক শান্তি নেই সেখানে হাজার কোটি টাকা, পদ-পদবি বা প্রভাব প্রতিপত্তি থেকে কী লাভ? পলাশ সাহার মৃত্যু বর্তমান অধঃপতিত সমাজের এক বাস্তব রূপ। একজন মা ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত যুদ্ধ করেন সন্তানকে যোগ্য মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে। মায়ের দায়িত্ব সন্তান জš§ দেয়া থেকে মানুষ করা পর্যন্ত শেষ, যথেষ্ট হয়েছে, এবার বিদায়! প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে আসবে বউ, এরপর মাসহ সবাইকে বাদ, তুমি এখন শুধুই আমার। আমি শুধু স্বামীকে নিয়ে স্বাধীনভাবে নিজের জীবন উপভোগ করতে চাই। এ রকমই (সবাই নয়) অনেক বউদের আচরণ।

পলাশ সাহার অসময়ে, অভিমানে চলে যাওয়াটা শুধুই আত্মহত্যা নয়! বর্তমান সমাজকে এবং বউ-শাশুড়িদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন, কত বড়ো মানসিক অসমতার স্বীকার ছিলেন পলাশ সাহা। তাতে মা তাঁর সন্তান হারালো, আর বউ হারালো স্বামীকে। কিন্তু এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার বুঝা যায়, (সুইসাইড নোট থেকে) গোল্ড নিয়ে বউ সম্ভবত একটা বারতি চাপ তৈরি করতেন। হয়তোবা সততা নিয়ে চলতে গিয়ে এ চাহিদা মেটাতে পলাশের হিমশিম খেতে হতো। কারণ একজন লোভহীন অফিসারের এ চাহিদা সবসময় মেটানো সম্ভব নয়। আর বউদের কখনোই বড়দের সঙ্গে বেয়াদবি করা ঠিক নয়। আর সেটা যদি হয় নিজ মাকে মানসিকভাবে হেয় বা শারীরিকভাবে আঘাত করা, সেটা তো কোনো সন্তানই মেনে নিতে পারে না।

পরিবারে বউ-শাশুড়ি মিল থাকলে প্রতিটি ফ্যামিলি সুখী হতো। এখনকার মেয়েরা শুধু একটি ছেলেকেই বিয়ে করে। মেয়েরা বউ হয়ে এসে পুরা বাড়িটা দখল করে নেয়। বিয়ের পর বাবা-মা মনে করে আমরা ছেলেকে অনেক কষ্ট করে বড় করেছি, সব অধিকার আমাদের। বউকে কেনো এত্তো সময় দেবে, ঘুরবে, ভালোবাসবে। অপরদিকে বউ মনে করে আমার স্বামী, আমিতো সব। ওরা কারা, ওরা কেনো আমার স্বামীর ওপরে অধিকার খাটাবে। আর এইভাবে দুই বিপরীত মেরুকে সামলে রাখতে, সুখী রাখতে, ভালো রাখতে একটি পুরুষের জীবন তেজপাতা! পলাশ হয়তো দুই মেরু থেকেই ব্যাপক চাপে ছিল, তাই আর চাপ নিতে পারেনি। অধিকাংশ পুরুষ বিয়ের পর উভয় সংকটে পড়ে। একদিকে অর্ধাঙ্গিনী অন্যদিকে গর্ভধারিনী মা, এ দু’য়ের মধ্যে ভারসাম্য না আনতে পারলে পুরুষের জীবনই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে শাশুড়িরা কি বউকে নিজ মেয়ের মতো দেখে? শাশুড়িরা যেভাবে বউয়ের দোষ ধরে, আর ছেলেকে ‘কান পড়া’ দেয়, নিজের মেয়ে হলে সেভাবে মেয়ের জামাইকে কান পড়া দেয়? দেয় না। শুধু ছেলের বউয়ের সব থাকে, নিজের মেয়ের সময় সেগুলো থাকে না। আমি বলছি না পৃথিবীর সব শাশুড়িরাই ভালো/মন্দ, কেউ কেউ আছে হয়তোবা একটু মিস বিহেভ করে। কিন্তু সেক্রিফাই মাইন্ডটা বউ ও মায়ের অবশ্যই থাকতে হবে।

সবসময় আমরা নারী নির্যাতনের কথা শুনি-দেখি। কিন্তু পুরুষ যে নীরবে কত নির্যাতিত হয়, তা কেউ দেখেও দেখে না, বুঝেও বুঝে না। বিশেষ করে বিয়ের পর যখন বউ ও মায়ের দ্বন্দ্ব চলে তখন পুরুষ পড়ে যায় মহাবিপদে! এই সিচুয়েশনে তারা বেশির ভাগই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কারণ বউয়ের পক্ষ নিলে মা নারাজ। মায়ের পক্ষ নিলে বউ নারাজ।
নিজের শাশুড়ি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, তার সঙ্গে কোনো কম্পিটিশন নয়। কারণ সে আপনার শাশুড়ি, অন্য ঘরের কেউ নয়। আর প্রতিটি মায়ের উচিত, তার ছেলের বউকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভাবা। কারণ সে আপনার ছেলের বউ, শত্রু নয়। প্রতিটি পুরুষের উচিত যেকোনো পরিস্থিতিতে শক্ত হয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া। বউ-শাশুড়ি একে অপরের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতনা। নারী ইচ্ছে করলে একটা সংসার সুখের সাগরে ভাসিয়ে দিতে পারে, অন্যদিকে একটা সংসারকে তছনছ করে দিতে পারে। যারা শাশুড়ি-বৌমা দুজন দুজনকে মেনে নিয়েছে তাদের জীবনে সুখের শেষ নই। আর যারা দুজন দুজনকে মানতে পারেনি সে পরিবারের স্বামী নামের আসামির জীবনটাই নরক।

পলাশ সাহার চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার মৃত্যুর জন্য মা এবং বউ কেউ দায়ী না। আমিই দায়ী…। চিরকুটটি ছোট, তবে এই চিরকুটে পরিবারের সঙ্গে প্রত্যেক ছেলের বাস্তব যুদ্ধটা প্রকাশ পেয়েছে! এ যেন বাংলাদেশের পরিবারের দায়িত্ব নেয়া সব ছেলের মনের অবস্থা! ‘ আমিই দায়ী’ এ শব্দ দুটিতে বোঝা যায়, কতটা নিঃসঙ্গতা, ক্লান্তি আর আত্মদহন জমে ছিল পলাশের মাঝে। স্ত্রী নাকি মা? দোষ কার? দোষ যারই হোক দিনশেষে ক্ষতি হলো দুজনেরই। একজন হারালো স্বামী, আর অপরজন তার সন্তান। হাইরে বোকা নারী!