নিজস্ব প্রতিবেদক : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ চতুর্থ পর্যালোচনা সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। এর ফলে আইএমএফ চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যেই চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি মিলিয়ে প্রায় এক দশমিক তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার একসঙ্গে ছাড় করতে পারে বলে আশা করছে সরকার। শুধু তাই নয়, আইএমএফ ছাড়াও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেও প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা আসবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
গতকাল বুধবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ব্যবস্থায় সংস্কার এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা-সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা সফল হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্র্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ পর্যালোচনা মিশনে গঠনমূলক আলোচনা হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন সম্মেলনে এসব বিষয়ে আরও উচ্চপর্যায়ের আলোচনা হয়। পরিশেষে উভয়পক্ষ সংস্কার কাঠামো ও অর্থ ছাড়ের বিষয়ে চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইএমএফের এই অর্থ ছাড় কেবল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিই নয়, বরং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতেও বড় ভূমিকা রাখবে। চলমান ডলার সংকট, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক দেনা পরিশোধে চাপের মধ্যে এই সহায়তা অর্থনীতির জন্য আশার আলো হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক আইএমএফ কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর এক বক্তব্যে বলেন, ‘এই জুন মাসেই আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, এআইআইবি, ওপেক ফান্ডসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়া যেতে পারে।’
চতুর্থ পর্যালোচনার আলোচনায় রাজস্ব আদায় কাঠামো ঢেলে সাজানো, করজাল সম্প্রসারণ, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রশাসনের ডিজিটালাইজেশন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বৃদ্ধির মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার অগ্রাধিকার পেয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ধাপে ধাপে বাজার-নির্ধারিত বিনিময় হার ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আইএমএফের দেয়া শর্তগুলোর মধ্যে অধিকাংশই বাংলাদেশ সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ। তবে এসব শর্ত বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতার দিকটি নিশ্চিত করা জরুরি।
আইএমএফের কিস্তি ছাড় ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, এডিবি, এআইআইবি ও অন্যান্য অংশীদারদের থেকে বাজেট সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এ অর্থ সরাসরি সরকারের কোষাগারে প্রবেশ করবে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও ভর্তুকি খাতে ব্যয় নির্বাহে ব্যবহৃত হবে।
বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে থাকলেও রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় কাক্সিক্ষত গতিতে না বাড়ায় চাপে রয়েছে অর্থনীতি। বাজেট সহায়তা এই চাপ সামলাতে সাময়িক স্বস্তি এনে দিতে পারে। একইসঙ্গে এই অর্থ সরকারকে আমদানি দায় মেটাতে ও মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে, ‘যেসব কাঠামোগত সংস্কার গ্রহণ করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে পরিকল্পিত। উন্নয়ন সহযোগীদের ভূমিকা কেবল কারিগরি সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ।’ এতে বোঝা যায়, সরকার আন্তর্জাতিক চাপের কারণে নয়, বরং নিজেদের প্রয়োজন ও ভবিষ্যতের লক্ষ্য মাথায় রেখে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করছে- এমন বার্তাই দেশ-বিদেশের কাছে পৌঁছে দিতে চায়।
আইএমএফের অর্থ ছাড় ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের বাজেট সহায়তা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় সুযোগ। তবে অর্থের চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছেÑএই অর্থের যথাযথ ও স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিত করা। কেবল অর্থপ্রাপ্তি নয়, সেই অর্থ কীভাবে বিনিয়োগ হচ্ছে, কী ফল আসছে, তা পর্যবেক্ষণ করাও এখন জরুরি। এই অর্থনৈতিক সাপোর্ট যদি পরিকল্পিতভাবে ব্যবহৃত হয়, তবে আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল ও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।