সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দেশে প্রতিদিন ১০ নারীর মৃত্যু

শেয়ার বিজ ডেস্ক : দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩৬ লাখ শিশুর জন্ম হয়। এর মধ্যে গর্ভধারণজনিত জটিলতায়, প্রসবকালে ও প্রসব-পরবর্তী বিভিন্ন সমস্যায় বছরে মৃত্যু হচ্ছে ৩ হাজার ৭০০ প্রসূতির। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে মারা যাচ্ছেন ১০ জন মা। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ ছাড়া বাকি দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য পরিস্থিতি খারাপ। বৈশ্বিক মাতৃমৃত্যুর প্রবণতা বিষয়ে ২০২৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফ ও ইউএনএফপিএর সবশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।

আবার বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) সবশেষ সমীক্ষা বলছে, বর্তমানে প্রসবজনিত মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬৩ জন। এর মধ্যে রক্তক্ষরণজনিত জটিলতায় মৃত্যু হয় ৩০ শতাংশের বেশি। খিঁচুনিতে ২৩ শতাংশ এবং অন্যান্য জটিলতায় ২১ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হয়। এ ছাড়াও গর্ভপাত এবং সন্তান জন্মদানকালেও অনেকের মৃত্যু হয়ে থাকে। দেশে ২০০১ সালে প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মে এ হার ছিল ৩২২ জন। সবশেষ ২০১৬ সালে মাতৃস্বাস্থ্য জরিপে মাতৃমৃত্যুর হার পাওয়া গিয়েছিল ১৯৬। এর পর সরকারিভাবে আর কোনো জরিপ হয়নি। ২০২৫ সালে অর্থাৎ গত দুই মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। কিন্তু জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০-এ নামিয়ে আনা। ফলে সরকারের হাতে সময় আছে পাঁচ বছর। তাই এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সংশয় প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, দেশে গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সেবার চরম ঘাটতি রয়েছে। এখনও হোম ডেলিভারি বা বাড়িতে সন্তান প্রসবের হার ৫০ শতাংশের বেশি। কিন্তু হাসপাতালে ও ক্লিনিকে প্রসব হলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশে কম থাকে। এ ছাড়াও প্রসব-পরবর্তী জটিলতা ও রক্তক্ষরণ, বাসাবাড়িতে অদক্ষ ধাত্রী দিয়ে সন্তান প্রসব, স্থানীয় পর্যায়ে জরুরি ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি, পারিবারিক, আর্থিক ও সামাজিক এবং সরকারি ব্যবস্থাপনার গাফিলতির কারণেই মাতৃমৃত্যু কমানো যাচ্ছে না। তাই নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবার ব্যাপ্তি ও মান বাড়ানোর পরামর্শ দেন তারা। এমন বাস্তবতায় আজ পালিত হচ্ছে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, বছরে ১৬ লাখের মতো শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রোপচারে। এর মধ্যে আবার অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে ১০ লাখ ৮০ হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে। তার মধ্যে সরকারি হাসপাতালে জন্ম ১৪ শতাংশ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে ৮৪ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে আর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে হচ্ছে ২ শতাংশ। আর দেশে মোট মাতৃমৃত্যুর ৭৩ শতাংশই ঘটে প্রসবের পর, যার ৫৫ শতাংশই প্রসবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘটে থাকে। আর এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটতে গিয়ে মারা যাচ্ছে ১৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের যৌথ প্রতিবেদন ‘মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ অনুসারে দেশে গর্ভাবস্থায় অন্তত একবার সেবা নেন ৭৫ শতাংশ মা। পূর্ণ চারবার সেবা নেন মাত্র ৩৭ শতাংশ মা।

আর ২০২২ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশের সরকারি হাসপাতালে প্রথমবারের তুলনায় চতুর্থবার সেবা নেওয়ার হার ৬৪ শতাংশ কম। আর পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ইউনিয়ন থেকে জেলা পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে প্রথমবারের তুলনায় চতুর্থবার পর্যন্ত নারীদের সেবা নেওয়ার হার ৬০ শতাংশেরও কম ছিল। আর একটি ইউনিয়নে গড়ে ৩৭ জনের বেশি মা অন্তঃসত্ত্বা থাকেন। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসক থাকেন না। প্রসবকালীন সেবা দেন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল কর্মকর্তা (স্যাকমো) এবং পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক (এফডব্লিউভি)।

যদিও জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গর্ভাবস্থায় একজন নারীকে চারবার স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া কথা থাকলে পূর্ণ সেবা নিয়ে থাকেন মাত্র ৩৭ শতাংশ নারী। আর ৪৭ শতাংশ প্রসূতি প্রসব-পরবর্তী সেবা বা পোস্ট-নেটাল কেয়ার (পিএনসি) গ্রহণ করছেন না। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চেয়ে শুধু মাতৃমৃত্যুর হার বেশি দেখা যায় আফগানিস্তান, নেপাল ও পাকিস্তানে। দেশ তিনটিতে এ হার যথাক্রমে ৬২০, ১৭৪ ও ১৫৪। মাতৃমৃত্যুর হার সবচেয়ে কম শ্রীলঙ্কায়। দেশটিতে ১ লাখ শিশু জন্মে ২৯ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। মালদ্বীপ ও ভুটানে এ হার তুলনামূলকভাবে কম, যথাক্রমে ৫৭ ও ৬০ শতাংশ। আর প্রতিবেশী ভারতে এ হার ১০৩ শতাংশ।

দেশে মৃত্যুর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী ড. আহমদ এহসানূর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, দেশে মাতৃমৃত্যুর হার রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আগে যা ছিল তাই রয়ে গেছে। আর মাতৃমৃত্যু এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের হাতে আর মাত্র পাঁচ বছর রয়েছে। ফলে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে যেতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। বিশেষ করে ২০০০ সালের পর থেকে যে গতিতে মাতৃমৃত্যুর হার কমছিল সেটি ২০১০ সালের পর আর বজায় রাখা যায়নি। বর্তমানে যে হারে মাতৃমৃত্যু কমছে এ হারে এগোলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এসডিজি অর্জন সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, প্রসবকালীন সময়ে রক্তক্ষরণ হলে জটিলতা তীব্র আকার ধারণ করে। ফলে জরুরি ভিত্তিতে জরুরি সেবার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সঠিক সময়ে প্রসূতিকে হাসপাতালে না আনা এবং এলেও তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। ঠিক স্থানে ঠিক সময়ে পৌঁছাতে না পেরে বাংলাদেশে বছরে ৯০০ মায়ের মৃত্যু হয়। কিন্তু এ মৃত্যু কাম্য নয়।

ড. আহমদ এহসানূর রহমান বলেন, দেশের মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ মাতৃমৃত্যু কমানোর জন্য নতুন কোনো ব্যবস্থাপনা যুক্ত হয়নি। সেবার মান নিশ্চিত করা যায়নি। আরেকটি সমস্যা হলো অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ না করা। মৃত্যুরোধে প্রকল্পভিত্তিক কাজ করা হতো। প্রকল্পের টাকা থাকলে কাজ হতো, টাকা না থাকলে কাজ নেই। সুতরাং প্রকল্পভিত্তিক নয়, এটিকে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

প্রসূতি চিকিৎসকদের সংগঠন ‘অবসট্রিটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ (ওজিএসবি) সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফেরদৌসী বেগম সময়ের আলোকে বলেন, প্রসব-পরবর্তী সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভধারণজনিত জটিলতার কারণে, প্রসবকালে এবং প্রসব-পরবর্তী জটিলতার কারণে কোনো নারীর মৃত্যুর হলে তাকে মাতৃমৃত্যু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু মাতৃমৃত্যুর হারে অনেক অগ্রগতি হলেও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। এখন মৃত্যু কীভাবে কমানো যায় কিংবা উন্নত বিশ্ব কীভাবে ভালো রাখে তা দেখতে হবে।

দেখা গেছে, তাদের কিছু জেনারেল ফ্যাক্টর রয়েছে। যেমন তাদের শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন কেমন? কিন্তু আমাদের দেশে সর্ম্পূণ ভিন্ন চিত্র রয়েছে। একজন নারী গর্ভবর্তী কী খাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পুষ্টির অভাব এবং স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে অনেক নারী ভালো নেই। আবার সচেতনতার অভাব রয়েছে, পারিবারিক শিক্ষা কম, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নারীরা অনেক পিছিয়ে। কোনো ধরনের সিন্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নারীর নেই। অনেক সম্পদ থাকতে পারে; কিন্তু সেই টাকা খরচ করার ক্ষমতা নেই কিংবা দেওয়া হচ্ছে না। তাকে সম্পদের অধিকার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিতে হবে। আমাদের দেশে সব নারীর যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকত তা হলে মৃত্যুর হার অনেক কমে যেত। ফলে নারীদের ক্ষমতায়ন করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, নারীরা যদি বাচ্চা নেওয়া বন্ধ করে দেয় তা হলে দুনিয়া শেষ। এখন একজন নারীকে গর্ভধারণের আগে থেকে প্রসব পর্যন্ত চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হয়। সন্তান ধারণের পর থেকে নিয়মিতভাবে চারবার প্রসবপূর্ব সেবা নেওয়ার নিয়ম হলেও সেটি পালন করা হচ্ছে না। তারা আসছে না। দেখা যাচ্ছে একবার আসছে মাত্র ৭০ শতাংশ জন। চারবার আসে মাত্র ৪০ শতাংশ। এখন যদি চিকিৎসকের কাছে না আসেন তা হলে কীভাবে বুঝবে সে সুস্থ আছেন কি না। আবার হাসপাতালগুলোতে ভোগান্তি, বেসরকারি হাসপাতালগুলো অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বেশি হচ্ছে, উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ দক্ষ জনবলের ঘাটতিসহ বিভিন্ন জটিলতা রয়েছে। আবার বাচ্চা হওয়ার পরও নবজাতকের ছয়বার আসার নিয়ম থাকলেও আসে না। ফলে নানা কারণে আমাদের দেশে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস কমাতে সবাইকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে।