মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স মো. সুলতানুজ্জামান তিতু চাকরি করতেন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায়। কিন্তু কৃষিজমিতে লাগাতার রাসায়নিক সার ব্যবহারে ক্রমেই কমছে উর্বরতা এবং নষ্ট হচ্ছে মাটির প্রাণ ও পরিবেশ, যা গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল স্বপ্নবাজ তিতুকে। মাটির টান ও পরিবেশের আহ্বান উপেক্ষা করতে না পেরে উন্নয়ন সংস্থায় লক্ষাধিক টাকার চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন গ্রামের মাটিতেÑযশোরের মণিরামপুর উপজেলার জামজামি গ্রামে। শুরু করেন কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনের অভিনব উদ্যোগ। স্বপ্নের নাম ‘দীপ্ত ভার্মি কম্পোস্ট স্টেট’। তিতু বিশ্বাস করেন, মাটি ভালো থাকলে কৃষকও বাঁচে, দেশও এগিয়ে যায়।
শুরুটা ছোট হলেও স্বপ্নটা ছিল অনেক বড়। ২০২১ সালের মে মাসে যশোরের মণিরামপুর উপজেলার জামজামি গ্রামে মুক্তেশ্বরী নদীর তীরে মাত্র ৫৬ শতক জমিতে ৬টি রিংসø্যাব ও আড়াই কেজি কেঁচো নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তিতু। শুরুতে উৎপাদিত কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) ব্যবহার করেন নিজের নার্সারিতে। ফলাফল দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন স্থানীয় কৃষকরা।
চার বছরের ব্যবধানে সেই ক্ষুদ্র উদ্যোগ এখন রূপ নিয়েছে বিশাল খামারে। বর্তমানে তার খামারে ৪৮টি হাউস ও সাতটি শেড রয়েছে, যেখানে প্রতি দুই মাসে উৎপাদিত হয় প্রায় ৭৫-৭৭ মেট্রিক টন কেঁচো সার।
২০২২ সালে এই প্রকল্পে যুক্ত হন তিতুর চাচাতো ভাই ইফতেখার সেলিম অগ্নি। পার্বত্য অঞ্চলে কাজুবাদাম, মাল্টা, চুঁইঝাল ও সজিনার বাগান থাকা এই উদ্যোক্তা বছরে চার-পাঁচশ টন কেঁচো সার ব্যবহার করেন। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় ‘দীপ্ত ভার্মি কম্পোস্ট স্টেট’ এখন একটি সম্মানজনক নাম।
উপকারভোগীরা যশোর সদরের বাজুয়াডাঙ্গা গ্রামের নার্সারি ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন জানান, ‘গোলাপ ক্ষেতে এই সার ব্যবহার করে চারার গুণগত মান ও ফুলের সৌন্দর্য অনেক বেড়ে গেছে। আগে যে চারা ২০ টাকায় বিক্রি করতাম, এখন তা ৪৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। সার খরচও অর্ধেক কমেছে।’
একই মত পোষণ করেন মাছচাষি আমির হামজা জেকো, যিনি জানান, ‘ছয় বিঘা জমির পুকুরে ভার্মি কম্পোস্ট প্রয়োগে পানিতে প্রাকৃতিক প্ল্যাঙ্কটন তৈরি হয়, যা মাছের খাবার হিসেবে কাজ করে। এতে মাছ চাষে খরচ কমে, লাভ বাড়ে।’
তিতু-অগ্নির খামারে ব্যবহার করা হয় তিন ধরনের কেঁচো। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান ভ্যারাইটি গোলাপি কেঁচো সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর। এসব কেঁচোর কেজিপ্রতি দাম ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। কেঁচো সংগ্রহ করা হয় খুলনার ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরার তালা, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ এবং যশোরের কেশবপুর থেকে।
কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী যশোরে প্রায় ছয় হাজার ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনকারী রয়েছেন। তাদের অধিকাংশই নারী। তারা দীর্ঘদিন ধরে ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করলেও ঠিকমতো বাজারজাত করতে পারছেন না। এ কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অনেকে। এমনকি কেউ কেউ উৎপাদন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। নারী উৎপাদনকারীদের অভিযোগ, কৃষি বিভাগ ভার্মি কম্পোস্ট নিয়ে তেমন প্রচার চালায় না। কৃষক এ সারের গুণাগুণ সম্পর্কে ঠিকমত ওয়াকিবহাল নয়। এ কারণে মাটির জন্য উপকারী ভার্মি কম্পোস্ট অনেক কৃষকই ব্যবহার করেন না। এসব অভিযোগের মধ্যে কৃষি অধিদপ্তর ও কৃষি মন্ত্রণালয় এ সারকে কৃষকবান্ধব করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এ সম্পর্কে লিফলেট ছেপে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণও করছে কৃষি অধিদপ্তর ও কৃষি মন্ত্রণালয়।
জামজামি গ্রামের এক নার্সারিতে দেখা মেলে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সতীশ মল্লিকের সঙ্গে। কেঁচো সার সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘রাসায়নিক সার ব্যবহারে মাটির ভেতরের জৈব পদার্থ ও অণুজীব ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে মাটি হয়ে পড়ে বিষাক্ত ও নিষ্প্রাণ। অথচ ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করলে সেই অণুজীব ফিরে আসে, গাছ প্রকৃত পুষ্টি পায়, রোগবালাই কমে, পরিবেশ থাকে সুস্থ, আর খাদ্য হয় নিরাপদ ও বিষমুক্ত।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ অফিসার কৃষিবিদ আবু তালহাও এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘সাধারণভাবে মাটিতে পাঁচ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে তা নেমে এসেছে মাত্র ১ থেকে ১ দশমিক ৩ শতাংশে। জৈব সার, বিশেষ করে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহারে মাটির গঠন ও উর্বরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।’ এ প্রেক্ষাপটে মো. সুলতানূজ্জামান তিতুর উদ্যোগ যেন সময়ের দাবিকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালে জন্ম নেয়া এই স্বপ্নদ্রষ্টা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে মাস্টার্স করে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেছেন পরিবেশ ও টেকসই কৃষির নানা প্রকল্পে। এখন নিজের গড়া ‘দীপ্ত ভার্মি কম্পোস্ট স্টেট’-এ তিনি নিয়োজিত আছেন মাটি বাঁচানোর কাজে। এখানে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন দুই কর্মী, পার্টটাইমে আরও আটজনÑএকটি ছোট্ট টিম, কিন্তু বড় এক পরিবর্তনের বাহক।