সাইদ সবুজ, চট্টগ্রাম: রেলওয়ে ঊর্র্ধ্বতন কর্তাদের গাফিলতি ও সদিচ্ছার অভাবে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই বিষাক্ত পানি সরবরাহ করছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ। ফলে অনুপযোগী পানি ব্যবহার করে এসব এলাকার বসবাসকারীদের মধ্যে নানা রকম পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে।
গত আগস্টে বেসরকারি এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায় দেখা যায়, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে সরবরাহ করা বিভিন্ন এলাকার পানির সাতটি গুণের সব কয়টিতেই সমস্যা রয়েছে। এতে দেখা যায়, পূর্বাঞ্চল রেলে সরবরাহ করা পানির রং কিছুটা অস্বচ্ছ ও স্বাদ পানের উপযুক্ত না। প্রতি লিটারে দ্রবীভূত কঠিন পদার্থের পরিমাণ দুই হাজার ৪০ মিলিগ্রাম, যেখানে গ্রহণযোগ্য মান ২৫০ মিলিগ্রাম। এছাড়া হার্ডনেস, ক্লোরাইড ও আয়রন রয়েছে প্রতি লিটার পানিতে যথাক্রমে এক হাজার ৩৮০ মিলিগ্রাম, ৬৬০ মিলিগ্রাম ও দশমিক ৭০ মিলিগ্রাম। যদিও পানিতে এ তিনটি উপাদানের গ্রহণযোগ্য মান যথাক্রমে ৫০, ২৫০ ও দশমিক ৩০ মিলিগ্রাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পূর্বাঞ্চলের রেলওয়ে হাসপাতাল, বাসাবাড়ি, অফিস ভবন ও বিভিন্ন স্থাপনা, সিআরবি, টাইগারপাস, পাহাড়তলী, গোয়ালপাড়াসহ ২০টি কলোনি মিলে এবং স্টেশনে ট্রেন যাত্রীসহ দৈনিক প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ হাজার মানুষ ব্যবহার করছে এ পানি।
দীর্ঘদিন ধরে এ বিষাক্ত পানি ব্যবহারের এসব এলাকার বসবাসরত মানুষের মধ্যে অ্যালার্জি, বিভিন্ন চর্মরোগ, পেটের সমস্যা, ডায়রিয়া, চুলপড়া ও নানা রকম পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। এছাড়া ঘোলা লবণাক্ত এ পানি রান্নার কাজেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে সমস্য হচ্ছে ডাক্তারদের। বাধ্য হয়ে বসবাসরত পরিবারগুলো বাইরে প্রতিদিন ৫০ হাজার মানুষকে বিষাক্ত পানি খাওয়াচ্ছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল থেকে পানি কিনে নিতে হচ্ছে। এতে সুযোগ নিচ্ছে অসাধু রেলওয়ের কিছু কর্মচারীসহ এলাকার রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী লোক। এতে মাসশেষে বিশাল অঙ্কের টাকা তাদের পকেটে যাচ্ছে। রেলওয়ের কর্তারা তা দেখেও না দেখার ভান করছেন।
এছাড়া চট্টগ্রাম রেলওয়ে ওয়ার্কশপ-মার্শালিং ইয়ার্ডে পানি সংকটে ট্রেন পরিচর্যা করতে অসুবিধা হচ্ছে। সিআরবি এলাকাসংলগ্ন গোয়ালপাড়া পানির পাম্প নষ্ট থাকায় পূর্বাঞ্চলের রেলওয়ে সদর দফতরের নিয়মিত কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। বর্তমানে ম্যাক্সের করা বদর পাম্প থেকে যে পানি দিচ্ছে এ পানি ব্যবহার উপযোগী নয়। রেলের মালিকানাধীন ফয়’স লেকের পানি দিয়ে পূর্বাঞ্চল রেলের আবাসিক এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহ করা হলেও ইজারাগ্রহীতা কনকর্ড গ্রুপ লেকের পানি দূষিত করে রাখায় অনিয়মিতভাবে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পানি সরবরাহ করা হচ্ছে আবাসিকের বাসিন্দাদের।
এর কারণ হিসেবে একাধিক রেলওয়ে স্টাফ মনে করছেন, ‘রেলওয়ে থেকে পানি পরিচর্যার ভার যদি ওয়াসার হাতে যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তারা বারবার ক‚প খনন ও পরিচর্যার খাতে যে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন, সেটা থেকে বঞ্চিত হবে। এছাড়া তারা আরও বলছেন অবৈধ পানি সরবরাহকারীরা যদি পাঁচ সাত লাখ টাকা খরচ করে ভালো পানি পায়, রেলওয়ে পায় না কেন?’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পানি নিয়ে সমস্যায় আছি। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি ধরে প্রয়োজনীয় কাজ সমাধান করেছি। বৃষ্টি মৌসুম শেষ হওয়ায় এখন বাধ্য হয়ে এই দূষিত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। গত কয় দিন ধরে আমার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নানা রকম পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। আমার মেয়ের পুরো মুখে কালো কালো দাগে ছেয়ে গেছে। জিএম সাহেবরা তো এখানে থাকেন না, তারা কী করে আমাদের কষ্ট বুঝবেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা (পূর্ব) ডা. পরিতোষ চক্রবর্তী শেয়ার বিজকে বলেন, রেলওয়ে হাসপাতালসহ এ এলাকায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যে পানি সরবরাহ করছে, এ পানি ব্যবহারের উপযোগী নয়। এ পানি ব্যবহারের ফলে নানা রকম পানিবাহিত রোগ দেখা দিতে পারে। এছাড়া পেটের সমস্যা, ডায়রিয়া, বিভিন্ন রকম চর্মরোগ, চুলপড়া ও অ্যালার্জিসহ নানা রোগ হতে পারে।
কামরুল হাসান নামের ঢাকাগামী এক যাত্রী শেয়ার বিজকে বলেন, আমি নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করি। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের খাবার পানিতে রয়েছে গন্ধ ও মারাত্মক লবণাক্ত। এ পানি মুখে নেওয়া যায় না। এ সমস্য থেকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে দ্রæত বের হয়ে আসা দরকার।
এছাড়া কিছুদিন আগে রেলওয়ের এসব এলাকায় সরবরাহ করা পানির নমুনা একটি বেসরকারি ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা যায়, এ পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়। গ্রিন ইনোভেশন নামের এ ল্যাবটি তাদের পর্যবেক্ষণে সাতটি বিষয়ের ওপর পর্যালোচনা করে। এতে বিএটিআই ও ডবিøউএইসও মাত্রার সঙ্গে অনেক ব্যবধান রয়েছে।
রেলওয়ে শ্রমিক লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারী পানি সমস্যায় ভুগছে। এ সমস্যা নিয়ে জিএমের কাছে গেলে তিনি সমস্যা সমাধানের জন্য প্রধান প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেন। কিন্তু এখনও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। আমাদের এখানে গোলায়পাড়ার পাম্পটি অকেজো হয়ে যাওয়ার পর পানির কষ্ট শুরু হয়েছে। এখন বদর পাম্পের পানি সরবরাহ করছে রেলওয়ে, এ পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে পানি কিনে অনেকেই কাজ শেষ করছেন। এ নিয়ে রেলওয়ের কিছু লোকসহ বাইরের মানুষ ব্যবসা করছে।
এ বিষয়ে বিভাগীয় প্রকৌশলী লিয়াকত শরীফ খান বলেন, এ সমস্য সমাধান হতে বেশ সময় লাগতে পারে। আমার মনে হয় না ওয়াসা নতুন লাইন আসার আগে কোনো সমস্যা সমাধান হবে। তবে অবৈধ পানির লাইন ও কী পরিমাণ পানি রেলওয়েতে ব্যবহার হয়, এর হিসাব দিতে পারেননি তিনি।
পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক চৌধুরী ঈশাই খলিল শেয়ার বিজকে বলেন, চট্টগ্রাম ওয়াসা থেকে পানি নেওয়ার জন্য ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। এখন ওয়াসা সিদ্ধান্ত নেবে আমাদের কীভাবে পানি দেবে। তবে রেল প্রশাসন এসব সমস্যার সমাধানের জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।