বৃদ্ধ প্রেস ব্যারনের প্রতিজ্ঞা

শামসুন নাহার: পলিয়েস্টার মহাযুদ্ধ টেক্সটাইল খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর জন্য হয়ে উঠল জীবন-মরণ প্রশ্ন। শিল্পপতিদের অস্তিত্বের সংকট। অন্যদিকে রাজীব গান্ধীর জন্য এটি ছিল ভারত সরকারকে পাপমুক্ত করার চ্যালেঞ্জ। হয়তো এটাকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে নিয়েছিলেন তরুণ প্রধানমন্ত্রী। ঠিক এ পর্যায়ে যুদ্ধের ময়দানে আগমন ঘটল নতুন আরেক দল যোদ্ধার। এ দলের সেনাপতি হলেন শেঠ রামনাথ গোয়েঙ্কা। ভারতের কিংবদন্তি এ মিডিয়া টাইকুন এসেছেন কলকাতার মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ী পরিবার থেকে। জানা যায়, ১৯২০-এর দশকে পারিবারিক চাপে পড়ে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মাদ্রাজে পাড়ি জমান গোয়েঙ্কা। সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন ইংরেজি সংবাদপত্রের চেইন গ্রুপ। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস নামের এ পত্রিকা পরে সারা দেশে ১২টি আঞ্চলিক এডিশন ও ছয় লাখ ৭০ হাজার গ্রাহকসংখ্যা নিয়ে সবচেয়ে বড় পত্রিকায় পরিণত হয়।

রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেসকে পছন্দ নয় গোয়েঙ্কার। তিনি ছিলেন খানিকটা তৎকালীন ডানপন্থি দল জনসংঘ ঘেঁষা। যদিও কোনো দলের প্রতিই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন না। বরং সরকারি দলের সমর্থক না হয়েই খুশি ছিলেন। নির্দ্বিধায় সরকারের খুঁত ধরতে পারতেন, দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করতে পারতেন। বেশিরভাগ মাড়ওয়ারির মতো শাকাহারিই ছিলেন গোয়েঙ্কা। কিন্তু কলমের খোঁচায় রক্ত ঝরাতে কখনও হাত কাঁপেনি তার। পঞ্চাশের দশকে ইন্দিরার স্বামী ফিরোজ গান্ধীকে নিয়োগ দেন গোয়েঙ্কা। মূলত তার উৎসাহেই কলকাতার শেয়ার ব্যবসায়ী হরিদাশ মুন্ধারা কেলেঙ্কারি ফাঁস করেন ফিরোজ। যে কয়টি সংবাদপত্র জরুরি অবস্থার সময়ে ইন্দিরার আরোপিত নিয়মকানুনের বিরোধিতা করেছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তার মধ্যে অন্যতম। তখন বিল্ডিং কোড ভায়োলেশনের দায়ে নয়াদিল্লির পুরোনো ভবন ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইন্দিরা। এক্সপ্রেস এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে ইন্দিরার চক্ষুশূল হয়েছিল। অনেকে বলে, গোয়েঙ্কা নাকি একপর্যায়ে ইন্দিরাকে হুমকি দিয়েছেন। মৃত ফিরোজ গান্ধীর রেখে যাওয়া ব্যক্তিগত ডকুমেন্ট প্রকাশ করে সবাইকে জানিয়ে দেবেন তাদের অসুখী দাম্পত্যের কারণ। আর এ হুমকির ভয়েই নাকি গোয়েঙ্কাকে এড়িয়ে চলেছেন ইন্দিরা।

আবার ফিরে যাই মূলগল্পে। ১৯৮৫ সালের শেষের দিক। গোয়েঙ্কার বয়স তখন ৮১ বছর। অশীতিপর বৃদ্ধ হলেও মানসিকভাবে তখনও শক্তিশালী। চোখের জ্যোতি ক্ষীণ কিন্তু পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তখনও টনটনে। লড়াকু মনোভাবও শিথিল হয়নি একটুও। মুম্বাইয়ের এক্সপ্রেস টাওয়ারের ২৫ তলাবিশিষ্ট ভবনের ওপরে একটি বাহুল্য বিবর্জিত পেন্টাহাউজে থাকেন গোয়েঙ্কা। এখানে বসেই পত্রিকা পরিচালনার কাজ করেন। এখানে বসেই বিরাট এ গ্রুপের জন্য সম্পাদক নিয়োগ করেন, বরখাস্তও করেন। তার মানে এই নয় যে, তিনি নিঃসঙ্গ থাকেন বা একাকিত্ব ভালোবাসেন। বরং উল্টো। প্রতিদিন ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথিদের সঙ্গে দেখা করতেন। নিজেও সুযোগ পেলেই নয়াদিল্লিতে অবস্থিত এক্সপ্রেসের নিজস্ব গেস্ট হাউজে অংশ নিতেন। গোয়েঙ্কার সঙ্গে ধীরুভাইয়ের পরিচয় হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি। মুরলি দেওরার মাধ্যমে। মুরলিকে মনে আছে? পাইধোনির এ সুতার ব্যবসায়ী তখন থেকেই রাজনীতিতে ভীষণ আগ্রহী। কংগ্রেস পার্টি করতেন। কংগ্রেসের হয়ে সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন। প্রথম থেকেই ধীরুভাইকে খুব উচ্চাকাক্সক্ষী মনে হয়েছে গোয়েঙ্কার। উচ্চাকাক্সক্ষাকে ইতিবাচকভাবেই নিয়েছিলেন তিনি। ভারতকে এগিয়ে যেতে হলে ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রসর হতেই হবে। যুবক আম্বানিও গোয়েঙ্কার সান্নিধ্য ভালোবাসতেন। এক্সপ্রেস বিল্ডিংয়ে প্রায়ই আসতেন দেখা করতে। একপর্যায়ে আম্বানির পারিবারিক বন্ধুতে পরিণত হন গোয়েঙ্কা। আম্বানির ছেলেমেয়েরা তাকে ডাকত ‘আপ্পুজি’ (দাদা) বলে। তাদের দুজনের সম্পর্ক কিছুটা অদ্ভুতই বলতে হবে। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সত্ত্বেও সাংবাদিকতার জায়গায় আপস করেননি গোয়েঙ্কা। রিলায়ান্স জড়িত রয়েছে এমন রিপোর্ট ছেপেছেন প্রায়ই। আবার আম্বানি যখন এর প্রতিবাদ করেছেন, তখন তাকেও শান্তও করেছেন। বলেছেন এ রিপোর্টের টার্গেট হলো কংগ্রেস সরকার, রিলায়ান্স নয়। এর মধ্যে নুসলি ওয়াদিয়ার আগমন। এর আগেই জেআরডি টাটার স্নেহ অর্জন করেছেন নুসলি। নিঃসন্তান ও বৃদ্ধ টাটা সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন নুসলি ওয়াদিয়াকে। এবার ওয়াদিয়া হাত বাড়ালেন গোয়েঙ্কার দিকে। তিনিও অকালে হারিয়েছেন একমাত্র পুত্রকে। নিয়ম করে তার বাসায় গিয়ে দেখা করছেন ওয়াদিয়া। মাসে অন্তত একবার সস্ত্রীক লাঞ্চ বা ডিনার করছেন গোয়েঙ্কার সঙ্গে। একবার ডিনারে ওয়াদিয়ার ব্যবসায়িক হালচাল জানতে চাইলেন গোয়েঙ্কা। সময়টা ১৯৮৫ সালের অক্টোবর। ওয়াদিয়া বললেন, ভালোমন্দ মিলে চলছে। তিনি তখন গভীর জালে জড়িয়ে। তবু সে কথা পাড়লেন না। এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু ওয়াদিয়া পতœী মোরিন বাধা দিলেন। জানালেন, বোম্বে ডায়িং কীভাবে গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে। আরও জানালেন, এক্সপ্রেস গ্রুপের পত্রিকাও রয়েছে ষড়যন্ত্রকারীদের দলে।

সে দফায় তেমন কিছুই বলেননি গোয়েঙ্কা। কিন্তু পরদিনই বোম্বে ডায়িংয়ের হেড অফিস নেভিল হাউজে হাজির হলেন। কোনো ঘোষণা ছাড়াই সোজা ঢুকে গেলেন ওয়াদিয়ার রুমে। হাতে পেপার কাটিংয়ের একটি ফাইল। এগুলো ছিল বোম্বে ডায়িংয়ের বিরুদ্ধে ছাপানো মনগড়া রিপোর্ট। এমনকি ওইদিন গোয়েঙ্কার বিজনেস পেপার ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসও বোম্বে ডায়িংয়ের বিরুদ্ধে একটি রিপোর্ট এবং একই বিষয়ে সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করেছে। গোয়েঙ্কার মনে হয়তো অপরাধবোধ কাজ করছিল তখন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যে করেই হোক রিলায়ান্সের মদদপুষ্ট এসব রিপোর্টিংয়ের ইতি ঘটাবেন। এক্সপ্রেসের পত্রিকাগুলো থেকে এসব একেবারে দূর করবেন। সঙ্গে জাতীয় ওয়্যার সার্ভিস প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকেও রিলায়ান্সের প্রভাব থেকে মুক্ত করবেন। তখন এ সার্ভিসের চেয়ারম্যান ছিলেন গোয়েঙ্কা।

কিন্তু ৩১ অক্টোবর প্রেস ট্রাস্ট রিলায়ান্সের পাবলিক রিলেশন অফিসার কীর্তি আম্বানির (আম্বানি পরিবারের নন) দেওয়া একটি প্রেস রিলিজের ওপর ভিত্তি করে নিউজ প্রকাশ করে। মে মাসে রিলায়ান্সের পিটিএ চুক্তিটি সিবিআই তদন্ত করছেÑএ মর্মে কয়েকদিন আগে রিপোর্ট প্রকাশ করা হলে তার জবাবে এ প্রেস বক্তব্য দেন কীর্তি। তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখেছি। এরকম কোনো সিবিআই তদন্ত হচ্ছে না। এটি একটি বড় প্রাইভেট টেক্সটাইল গ্রুপের ষড়যন্ত্র। এ ধরনের তদন্ত ডিএমটি আমদানি চুক্তির ওপরও হতে পারে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এ  ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপ তাদের ডিএমটি বিক্রি করতে পারছে না। প্রায় পাঁচ হাজার টন ডিএমটির বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আসলে তাদের ডিএমটি নি¤œমানের হওয়াতেই বিপাকে পড়েছেন তারা।

এ প্রেস রিলিজ পড়ে রেগে গেলেন গোয়েঙ্কা। তার মনে হলো, ব্যবসায় প্রতিযোগিতা থাকবে, ভালো। কিন্তু এ তো মিথ্যাচার। আরও রেগে গেলেন যখন জানতে পারলেন, তার নির্দেশ ছাড়াই রিলায়ান্সের সরাসরি যোগাযোগে পিটিআই ডেস্ক থেকে এ প্রেস রিলিজ ছাপানো হয়েছে। ওদিকে ততদিনে ওয়াদিয়ার প্রতি তার আন্তরিকতা আরও গভীর হয়েছে। ওয়াদিয়ার পাশে দাঁড়ালেন তিনি। এ রিপোর্ট প্রত্যাহার করে ও ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চেয়ে নোট প্রকাশ করার পিটিআই ডেস্কে নির্দেশ দিলেন গোয়েঙ্কা। ১ নভেম্বরে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া প্রকাশ করে: ‘প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া গতকাল রিলায়ান্স টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পাঠানো একটি প্রেস রিলিজের ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে মুম্বাইয়ের একটি স্বনামধন্য টেক্সটাইল কোম্পানির বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ করা হয়েছে। আমরা রিপোর্ট প্রকাশ করার আগে এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করিনি। এ কারণে অভিযুক্ত টেক্সটাইল কোম্পানির সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে তার জন্য আমরা দুঃখিত।’

এরপরের বার ধীরুভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতেই বিষয়টি পাড়লেন গোয়েঙ্কা। গোয়েঙ্কারই এক ঘনিষ্ঠজনের বরাতে জানা যায়, ধীরুভাই নাকি প্রেসকে কাজে লাগানোর ব্যাপারটি স্বীকার করেছিলেন গোয়েঙ্কার কাছে। বলেছিলেন, আমার একটি সোনার জুতা ও একটি রুপার জুতা আছে। কোনটা ছুড়ে মারব, তা নির্ভর করে কার কত দাম তার ওপর। সবারই একটি বিক্রয়মূল্য আছে।

গোয়েঙ্কা বুঝলেন। অর্থ দিয়ে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী পত্রিকাকে দলে ভেড়াতে চায় ধীরুভাই। কিন্তু ধীরুর হিসেবে ভুল হয়েছে। গোয়েঙ্কাকে পয়সা দিয়ে কেনা যাবে না। ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন গোয়েঙ্কা। ধীরুভাই এরই মধ্যে নিজের ইচ্ছেমতো এক্সপ্রেসের পাতায় রিপোর্ট করাতে পেরেছেÑএটা ভেবেই অপমানে পুড়ছিলেন তিনি। আর ধীরু এখন তার সামনে ‘সোনার জুতা, রুপার জুতা’ টাইপ কথা বলার সাহস করছে। আত্মরম্ভিতা এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, গোয়েঙ্কাকে কেনার কথা ভাবছে। প্রতিজ্ঞা করে নিলেন বৃদ্ধ প্রেস ব্যারন। তার হাতে যত শক্তি আছে সব কাজে লাগিয়ে হলেও আম্বানির গোমর ফাঁস করেই ছাড়বেন তিনি।