বড় প্রকল্প থেকে বৈদেশিক ঋণ কাটছাঁট হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের অর্থ এবারও পুরোপুরি খরচ হচ্ছে না। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বড় প্রকল্পগুলো থেকে বৈদেশিক ঋণ কাটছাঁট করা হচ্ছে। এবারের মূল এডিপিতে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৫৭ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার প্রত্যাশা করা হলেও সংশোধিত এডিপিতে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো কমছে। আগামীকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে এ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করার কথা রয়েছে।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভায় উত্থাপনের জন্য যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে, পরিকল্পনা কমিশন থেকে সেটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছেÑসংশোধিত এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকছে পরিবহন খাতে ৩৭ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। যা মোট বরাদ্দের ২৫ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকছে বিদ্যুৎ খাতে ২২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। যা মোট বরাদ্দের ১৫ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে আছে পল্লি উন্নয়ন ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগ ১৬ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। যা মোট বরাদ্দের ১১ শতাংশ। এরপর আছে ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ খাতে ১৫ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা।

এদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ বছরের সংশোধিত এডিপিতে আরও ৩১১টি নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। মন্ত্রী, এমপিদের নিজ নিজ এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে এসব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্পসংখ্যা দাঁড়াবে এক হাজার ৫১১টি। বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলে আসছেন, নতুন প্রকল্প না নিয়ে পুরোনো প্রকল্প শেষ করার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু সরকার সে পথে না হেঁটে নতুন নতুন প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছে। এতে করে এডিপিতে প্রকল্পজট তৈরি হচ্ছে।

জানতে চাইলে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা বরাবরই বলে আসছি, নতুন নতুন প্রকল্প না নিয়ে পুরোনো প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত শেষ করার বিষয়ে। নতুন প্রকল্প নেওয়ার কারণে সেসব প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ দিতে হচ্ছে। এতে করে সব প্রকল্পের ওপর সমান গুরুত্ব দেওয়া যায় না। যার ফলে প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। এতে প্রকল্প থেকে মানুষ সুফলও পায় না।’

জানা গেছে, অর্থবছরের আট মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো এখন বলছে, বছরজুড়ে এত টাকা খরচ করা যাবে না। বিদেশি ঋণের চার হাজার ৯৫০ কোটি টাকা ফেরত দিচ্ছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। সে কারণে মূল এডিপির তুলনায় সংশোধিত এডিপিতে বিদেশি ঋণের আকার কমে দাঁড়াচ্ছে ৫২ হাজার ৫০ কোটি টাকা। অবশ্য সংশোধিত এডিপিতে বিদেশি ঋণ কমলেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকা কমছে না। মূল এডিপিতে যা ছিল; অর্থাৎ ৯৬ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার পুরোটাই থাকছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর এডিপির আকার ছিল এক লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হয়েছিল ৯৬ হাজার ৩৩১ কোটি এবং উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ থেকে ৫৭ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে কমছে চার হাজার ৯৫০ কোটি টাকা।

কমিশনের যুগ্ম প্রধান এম সাঈদুজ্জামান জানান, ‘গতবারও বিদেশি ঋণ কমেছিল। কিন্তু সরকারি কোষাগার থেকে ওই ঘাটতি মেটানো হয়েছিল। সে কারণে সংশোধিত এডিপির আকার কমেনি। এবারও তা-ই হতে পারে। সরকারি কোষাগার থেকে বাড়তি টাকা দিয়ে সেটা পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

জানা যায়, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকাসহ উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুত ঋণ ব্যবহারের চেয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ খরচের দিকে বেশি ঝোঁক থাকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কর্মকর্তাদের। কারণ, বিদেশি ঋণ খরচ করতে গেলে নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। টাকা খরচে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হয়। সরকারের নিজস্ব তহবিল খরচের ক্ষেত্রে নিরীক্ষার বিষয়টি অতটা কড়াকড়ি নয়। ফলে প্রতিবছর এডিপি সংশোধনের সময় বিদেশি ঋণ কমে যায়। এ বছর তা-ই হতে চলেছে।

তবে নির্বাচনের বছর হওয়ায় এমপি-মন্ত্রীদের বাড়তি টাকার চাহিদা রয়েছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে। মন্ত্রী-এমপিরা নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নে ব্যস্ত। সে কারণে সরকারি কোষাগার থেকে বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা চাহিদা রয়েছে তাদের। সেক্ষেত্রে তাদের বাড়তি পাঁচ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত দেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে এবারও মূল এডিপির আকার যা ছিল, সংশোধিত এডিপির আকার তা-ই থাকতে পারে।

কমিশন সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে দুই হাজার ৪১০ কোটি টাকা রাখা হচ্ছে বিশেষ উন্নয়ন সহায়তা খাতে। চলতি বছরের অবশিষ্ট চার মাসে এ টাকা খরচ হবে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে। প্রতিবছরই বিশেষ উন্নয়ন সহায়তা বাবদ টাকা রাখে সরকার। বিশেষ উন্নয়ন সহায়তার টাকায় ব্যাপকহারে অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।