ইসমাইল আলী: ২০১৬ সালের অক্টোবরে ঢাকা সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সে সময় সাড়ে ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদানে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করা হয়। দেড় বছরে ওই ঋণের কোনো অর্থই ছাড় করেনি চীন সরকার। এর মধ্যেই গত আগস্টে হঠাৎ ঋণের শর্ত পরিবর্তন করেছে দেশটি। এবার সে শর্ত আরও কঠিন করা হলো। পাশাপাশি পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে প্রস্তাবিত ঋণের সুদহার বৃদ্ধি করেছে চীন।
চীনের ঋণের বিষয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এতে দেখা যায়, নমনীয় ঋণের জন্য প্রকল্প বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেবে চীন। এক্ষেত্রে প্রকল্পটি নিয়ে দুই পক্ষের দর কষাকষির আগেই আবেদন করতে হবে। এর সঙ্গে ১০ ধরনের সংশ্লিষ্ট নথিপত্র জমা দিতে হবে। তাদের অনুমোদনের পর দেশটির এক্সিম ব্যাংক আবার তা যাচাই-বাছাই করবে। এরপর ঋণচুক্তি সই হবে।
চিঠিতে জানানো হয়, জিটুজি ভিত্তিতে নমনীয় ঋণে বাস্তবায়িতব্য প্রকল্পের অর্থায়ন প্রক্রিয়াকরণে চীন সরকার একটি নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে, যা গত ৪ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও চীন সরকার জেনারেল কনসেশনাল লোন (জিসিএল) ও প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) ব্যবহার করছে। জিসিএল ও পিবিসির ক্ষেত্রে ভিন্ন পদ্ধতি থাকায় প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় তা নিঃসরণের লক্ষ্যে চীন সরকার নতুন বিধান চালুর প্রস্তাব করেছে, যা ২ নং পত্রের মাধ্যমে তার মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থাকে অবহিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে চীন সরকার কর্তৃক জিসিএলের ক্ষেত্রে প্রবর্তিত নতুন পদ্ধতির সঙ্গে আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে ১নং পত্রের মাধ্যমে এ বিভাগে প্রেরণ করেছে।
গত ৩১ জানুয়ারি চীনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কনস্যুলার স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, চীন সরকারের নমনীয় ঋণে জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে নতুন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে জিসিএলের আবেদনের সঙ্গে প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা, কারিগরি স্কিম ও নির্মাণের সম্ভাব্যতা স্কিম, বাহ্যিক সহায়ক পরিকল্পনা, পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা ও পরবর্তী পরিচালন ব্যবস্থাপনা স্কিম, বিনিয়োগের প্রাক্কলন, প্রকল্পের কারিগরি চার্ট এবং বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিমালা-সংক্রান্ত নথিপত্র।
আবেদনের সঙ্গে ১০ ধরনের নথিপত্র জমা দেওয়া হলে চীনের পক্ষ থেকে তা যাচাই-বাছাই ও প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চীনের অনুমোদনের পর প্রকল্পটির ব্যয়ের বিষয়ে বাণিজ্যিক চুক্তি সইয়ে দরকষাকষি শুরু হবে। আর বাণিজ্যিক চুক্তি সইয়ের পর সংশ্লিষ্ট উপকরণ চীনের এক্সিম ব্যাংকে পাঠাতে হবে প্রকল্পটির প্রয়োজনীয়তা যাচাই-বাছাইয়ে। এরপর চীনের এক্সিম ব্যাংক অনুমোদন দিলে ঋণ চুক্তি সই হবে। যদিও আগে দরকষাকষি ও বাণিজ্যিক চুক্তি সইয়ের পর এক্সিম ব্যাংকে আবেদন করতে হতো।
জানতে চাইলে চীনের চিঠি প্রাপ্তির বিষয়টি স্বীকার করে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব মো. জাহিদুল হক বলেন, চীনের ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে এমন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে দেশটির চিঠির অনুলিপি এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে। জিসিএল গ্রহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে তাতে।
এর আগে গত অক্টোবরে চীনের ঋণ বিষয়ে ইআরডিতে আরেকটি চিঠি দিয়েছিল দেশটির অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কনস্যুলার। এতে জানানো হয়েছিল, ঋণের শর্তে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে চীন সরকার। সেগুলো হলোÑকোনো প্রকল্পে ঋণের পরিমাণ ৩০ কোটি ডলারের কম হলে সেক্ষেত্রে ঋণের সম্পূর্ণ অংশ জিসিএল হবে। আর ঋণের পরিমাণ ৩০ কোটি ডলারের বেশি হলে তা হবে পিবিসি। আর পিবিসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চুক্তিমূল্যের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ অর্থায়ন করতে হবে।
চিঠিতে চীনের ঋণের এ শর্ত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। এর সঙ্গে জিসিএল ও পিবিসি প্রক্রিয়াকরণের শর্তও যুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে জিসিএল বা পিবিসির জন্য চীন সরকার একটা রিজার্ভ তৈরি করবে। এটি পাঁচ বছরের বেশি স্থায়ী হবে না। অর্থাৎ পাঁচ বছরের মধ্যে ঋণ ব্যবহার করতে হবে।
জিসিএলের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ঋণ চুক্তির আগে চীনের এক্সিম ব্যাংক ও বাংলাদেশের ইআরডির মধ্যে একটি কাঠামো চুক্তি সই হবে, যা তিন বছর বিদ্যমান থাকবে। এর মধ্যে প্রকল্পের দরপ্রক্রিয়া ও ঋণ চুক্তি সই করতে হবে। তবে পিবিসিএর ক্ষেত্রে এ ধরনের ধরা-বাধা কোনো নিয়ম থাকবে না।
এদিকে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে ২৬৬ কোটি ৭৯ কোটি ডলার ঋণ পিবিসি হিসেবে দেবে চীনের এক্সিম ব্যাংক। এ ঋণের জন্য দুই শতাংশ সুদহার প্রস্তাব করেছে চীন। এর সঙ্গে দশমিক ২৫ শতাংশ কমিটমেন্ট ফি ও দশমিক ২৫ শতাংশ ম্যানেজমেন্ট ফি প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও ২০১৬ সালে সইকৃত কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পে কমিটমেন্ট ফি ও ম্যানেজমেন্ট ফি ছিল দশমিক ২০ শতাংশ করে।
ছয় বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আর নতুন ঋণের শর্তানুযায়ী চুক্তি মূল্যের ৪৭ কোটি সাত লাখ ডলার বাংলাদেশ সরকারকে দিতে হবে। এছাড়া ঋণ চুক্তি কার্যকরের ৩০ দিনের মধ্যে ৬৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার ম্যানেজমেন্ট ফি হিসেবে পরিশোধ করতে হবে। গতকাল ইআরডিতে এ-সংক্রান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে রেলওয়ের পক্ষ থেকে ঋণের বিভিন্ন শর্ত মেনে নেওয়া হলেও কমিটমেন্ট ফি বছরভিত্তিক নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ ঋণ ছাড় করতে যত দেরি হবে কমিটমেন্ট ফি তত বাড়বে। তবে নতুন শর্ত কার্যকর হলে প্রকল্প বাস্তবায়নকাল তথা ছয় বছরে প্রায় সাত কোটি ডলার সাশ্রয় হবে বলে মতামত দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের অক্টোবরে ৩৪ প্রকল্পে ২৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন (দুই হাজার ৪৪৫ কোটি) ডলার ঋণ চাওয়া হয় চীনের কাছে। এর মধ্যে শিল্পোন্নয়ন সম্পর্কিত দুটি, রেলের উন্নয়নে পাঁচটি, সড়ক পরিবহনে চারটি, বিদ্যুতের সাতটি, জ্বালানির একটি, জীবনমান উন্নয়নে পাঁচটি এবং তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে চারটি প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। সে সময় এ-সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করা হয়। পাশাপাশি তিন প্রকল্পে ১১৭ কোটি তিন লাখ ডলার ঋণ সরাসরি প্রদানে চুক্তি সই করে চীন।