ব্যাংক-আর্থিক খাতের অনিয়ম ঠেকানোর দায়িত্ব এমডিদের

দীন মোহাম্মদ দেশের বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের দিকপাল। যার হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান ও পুরোনো সিটি ব্যাংক। তিনি সিটি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। তার প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর্থিক খাতের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি। এছাড়া ফিনিক্স ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স ও ফিনিক্স সিকিউরিটিজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তিনি। সেবা খাতের পাশাপাশি ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠায় তিনি সিদ্ধহস্ত। তিনি ইস্পাত খাতের এ্যাপোলো ইস্পাত, বস্ত্র খাতের ফিনিক্স স্পিনিং ও চামড়া খাতের ফিনিক্স লেদারের প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে এ্যাপোলো ইস্পাতের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। আবাসন খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ গ্রুপেরও তিনি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। সম্প্রতি শেয়ার বিজের সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এম এম জামান

শেয়ার বিজ: আপনার বর্ণাঢ্য ব্যবসায়ী জীবন ব্যবসার বয়সও অর্ধশত বছর পার হলো সময়ের মূল্যায়নটা করুন?

দীন মোহাম্মদ: আমি ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্য। বাবার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু। আমার এখন যা আছে, তা এই ২০ হাজার থেকেই হয়েছে। আমি সাহস নিয়ে ব্যবসা করেছি। প্রথম ট্রেডিং দিয়ে শুরু করলেও পরে উৎপাদন শুরু করি। কাপড়, চামড়া, ইস্পাতসহ অনেক কিছুই আমি উৎপাদন করেছি। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করে। আমি যা করেছি সাহস, সততা ও দৃঢ়তার সঙ্গে করেছি। কঠোর পরিশ্রম করেছি। কমিটমেন্ট ঠিক রেখেছি। তাই কোনো কিছুতেই ব্যর্থতা নেই।

শেয়ার বিজ: আপনার ব্যবসার শুরুর গল্পটা বলুন?

দীন মোহাম্মদ: ম্যাট্রিক পাসের পরই আমি ব্যবসায় ঢুকে পড়ি। তবে তার আগে আমি পুরো দেশটা ঘুরে দেখি। দেশের সবকটা বড় শহর, বিখ্যাত সব এলাকা ঘুরে ব্যবসায় মনোযোগ দিই। ব্যবসায়িক কাজে চীন ভ্রমণ করে আমার বিশাল অভিজ্ঞতা হয়। এ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে আমি এগিয়ে যাই। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

শেয়ার বিজ: আপনার ব্যবসায়ের সফলতার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে কী?

দীন মোহাম্মদ: আমার ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে আমার সাহস। আমি সাহস করে নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়েছি। আশির দশকে আমি বেসরকারি খাতে ব্যাংক করার উদ্যোগ নেই। তখন আমার ব্যবসায়ী বন্ধুরা অনেকেই উপহাস করেছে। কিন্তু আমি তো সফল হয়েছি। এভাবে যখন লিজিং ব্যবসা শুরু করি, তখন অনেকেরই পছন্দ হয়নি। কিন্তু এটাও সফল হয়েছে। সফলতা পেয়েছি ইস্পাত, বস্ত্র ও চামড়া খাতে।

শেয়ার বিজ: ব্যবসায়ীদের মধ্যে দীন মোহাম্মদের অন্য একটা পরিচয় আছে সেটা হলো তার কমিটমেন্ট ব্যাপারে কিছু বলুন

দীন মোহাম্মদ: আমি পুরান ঢাকার মানুষ। ছোটবেলা থেকেই শিখেছি জবানের মূল্য দিতে। এটা এখনও মেনে চলি। আমার জীবনে কখনও কোনো কমিটমেন্ট মিস করিনি। কাউকে কমিটমেন্ট দেওয়ার পর আমার ব্যবসায়ে কোটি টাকার ক্ষতি হলেও সেদিকে তাকাইনি। এ কারণে ব্যবসায়ীরা আমাকে পছন্দ করেন। ভালোবাসেন। আর এ ভালোবাসাই আমাকে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে।

শেয়ার বিজ: ব্যাংক আর্থিক খাত এখন খুব খারাপ সময় পার করছে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ঋণ জালিয়াতির কারণে ইমেজ সংকটে খাত খাতের একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে এটাকে কীভাবে দেখছেন?

দীন মোহাম্মদ: ব্যাংক খাতের এ অব্যবস্থাপনার জন্য অনেক কারণ থাকলেও এর জন্য মূলত ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) দায়ী। কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক না চাইলে ওই প্রতিষ্ঠানে কোনো অনিয়ম হতে পারে না। কারণ ব্যাংক পরিচালনা করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি সততা ও নিয়মানুবর্তিতা মেনে ব্যাংকিং করলে অনিয়ম হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তিনি যদি নিজেই অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন তাহলে তার অধস্তন সবাই অনিয়ম করবে, পুরো ব্যাংকে দুর্নীতি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে।

শেয়ার বিজ: ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের তো পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশ মেনে চলতে হয়?

দীন মোহাম্মদ: ব্যাংক পরিচালনা করে সিইও বা এমডিরা। পর্ষদ নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যাংকিং আইন ও বিধি অনুযায়ী পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত মেনে চলবেন তিনি। কিন্তু চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে এমডিরা বাধ্য নন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য চাকরি বাঁচাতে অনেকেই সেটা করছেন। এসব দুর্বল ব্যক্তিত্বের এমডিদের কারণেই ব্যাংক ও আর্থিক খাতের এখন দুঃসময় যাচ্ছে। তবে এখনও এ খাতে কয়েকজন সৎ ও সাহসী এমডি রয়েছেন, যারা সৎ ও স্বাধীনভাবে ব্যাংক পরিচালনা করছেন। তারা নিজেরাও অনিয়ম করেন না এবং পর্ষদের অনিয়মকেও প্রশ্রয় দেন না। ওই ব্যাংকগুলো কিন্তু ভালো করছে।

শেয়ার বিজ: ব্যাংক আর্থিক খাতের দুরবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?

দীন মোহাম্মদ: সবার আগে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আনতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব এমডিদের। এজন্য সবার আগে এমডিকে শতভাগ সৎ হতে হবে। নির্লোভ ও সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। চাকরির মায়া না করে শতভাগ পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। পরিচালনা পর্ষদকেও এমডিদের সহযোগিতা করতে হবে। পাশাপাশি অনিয়মের জন্য কঠোর শাস্তি দিতে হবে। তাহলেই এ খাতে সুদিন ফিরে আসবে।

শেয়ার বিজ: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ

দীন মোহাম্মদ: শেয়ার বিজ ও আপনাকে ধন্যবাদ