শামসুন নাহার রাখী: অনেকে বলেন, জীবনের সেরা জিনিসগুলো নাকি বিনা মূল্যেই পাওয়া যায়। এ রকম কথা যারা বলেন, তাদের হয়তো কখনও অনটনের মধ্যে সংসার শুরু করতে হয়নি। ভেবে দেখুন, আপনি ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে সংসার বাঁধবেন। গুঁড়োদুধের বিজ্ঞাপনের মতো দুটি ফুটফুটে বাচ্চা ছুটোছুটি করে বেড়াবে আপনাদের সংসারে। কিন্তু বর্তমানে আপনার আর্থিক অবস্থা একটি স্তরে এসে আটকে গেছে। অন্যদিকে শহরে বাড়ি ভাড়াও বাড়ছে হুহু করে। এছাড়া দিন দিন সভ্য ও সামাজিক জীবনযাপনের প্রক্রিয়া হয়ে উঠছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এমন পরিস্থিতিতে ঘর বাঁধার স্বপ্নটিও হয়ে ওঠে বিলাসিতা। এটাই এখন লাখো যুবক-মহিলার জীবনের চরম বাস্তবতা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের যুবসমাজের জন্যও সংসার শুরু করা এখন এক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।
২৫ থেকে ৩৫ বছরের যুবসমাজ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যস্ত। নিরাপদ জীবন পেতে চাইলে ব্যস্ত না হয়ে উপায়ও নেই অবশ্য। তাই যখন মোটামুটি আর্থিক স্থিরতা আসছে, ততদিনে বয়স যাচ্ছে ত্রিশের কোঠা পেরিয়ে আরও অনেক দূরে। বয়স বেড়ে যাওয়ায় বিয়ের ব্যাপারে দ্বিধায় ভুগছেন অনেকে। কেউ কেউ বিয়েটা বাদই দিয়ে দেন জীবন থেকে। অথচ আমাদের আগের প্রজšে§র অবস্থাও কিন্তু এমন ছিল না। তাদের সাধারণত ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে সংসার-স্বপ্নকে বিসর্জন দিতে হয়নি। তাছাড়া ২৫-৩০ বছর বয়সের মধ্যেই যার যার পেশায় বেশ থিতু হয়ে যেতেন তারা। এরপর সংসার শুরু করে বাকি জীবন ধরে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার পালা। সংসার তাদের অগ্রযাত্রায় বাধা হয়নি সেভাবে। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। জীবনের অর্ধেক পার করে এসেও ক্যারিয়ারের পথ নির্বাচন নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন অনেকে। এ অবস্থায় সংসার শুরু করাটা যেন আরও বড় অনিশ্চয়তার মুখে পড়ারই নামান্তর।
তবু বিয়ে তো থেমে নেই। বিশেষ করে শীতকালে যেন বিয়ের মৌসুম শুরু হয়। কিন্তু লক্ষ করলে দেখবেন, চাকরি পাওয়ার দু’এক বছরের মধ্যেই বিয়ে করতে পারছেনÑএমন ছেলেমেয়ের মধ্যে তারাই সংখ্যায় বেশি যারা আর্থিকভাবে পারিবারিক সুরক্ষা ভোগ করছেন। অর্থাৎ তাদের পরিবারের (বাবা-মা, ভাই-বোন) ভরণ-পোষণের দায় নিতে হচ্ছে না বা সচ্ছল বাবা-মা কিংবা পারিবারিক ব্যবসা থেকে আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন; কিন্তু এর বাইরেও এক বিরাট যুবসম্প্রদায় রয়েছে। তাদের কেউ কেউ বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করছেন। যাদের সেরকম দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না, তারাও বিয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত বোধ করছেন না। আবার যারা ঝুঁকি নিয়ে বিয়ে করেই ফেলছেন, তারাও অনেকে আর্থিক নিরাপত্তার অভাবে সন্তান নিতে দেরি করছেন।
সমাজের বেশ কিছু উপাদান এখনকার যুবসমাজের চিন্তায় গভীর পরিবর্তন এনেছে। বিয়ে করতে বা সন্তান নিতে দেরি করা, এমনকি সংসার গড়ার ব্যাপারটিকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে ফেলার যে প্রবণতা তৈরি হয়েছেÑতার পেছনেও এসব উপাদানের প্রভাব রয়েছে। যেমন আমাদের আগের প্রজš§ যতটা দক্ষতা নিয়ে কর্মজীবন শুরু করতেন, এখন তারচেয়ে অনেক বেশি দক্ষতা প্রয়োজন হচ্ছে। বর্তমানে সামান্য বেতনের নির্বাহী পদের জন্য সর্বোচ্চ ডিগ্রি চাওয়া হয়। সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারিক কাজের দক্ষতার জন্য বাড়তি কোর্স রিপোর্টও দরকার পড়ে। সব চাহিদা মিটিয়ে, বিভিন্ন দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে তবেই পাওয়া যায় পছন্দমতো কোনো কাজ। কাজ করতে করতে শেখার ধারণাটি নিয়োগকর্তারা যেন বাতিল ঘোষণা করেছেন। তবুও সে চাকরি পেয়েও সন্তুষ্টি পাওয়া যায় না। কারণ, চড়াইয়ের ধাপে ধাপে মূল্যস্ফীতি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে মাত্র আট-দশ বছর আগেও যে বেতনকে ‘হ্যান্ডসাম স্যালারি’ মনে হতো, তাকে এখন রীতিমতো জীর্ণশীর্ণ ও কুৎসিত বলে মনে হয়। ফলে ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন অনেকেই। এ অবস্থায় বিয়ে-সংসারের ভাবনা ভয়ের উদ্রেক করে বৈকি!
শহুরে জীবনে আরেকটি বড় সমস্যা হলো মনমতো থাকার জায়গা বা আশ্রয় খুঁজে পাওয়া। ব্যাচেলর জীবনে বাসস্থান খুব একটা খরুচে না হলেও বিবাহিতদের জন্য নিজস্ব একটি বাসা না হলেই নয়। কিন্তু শহরে, বিশেষত রাজধানীতে বাসা ভাড়ার পেছনেই চলে যায় আয়ের সিংহভাগ। সেখানে চাকরিজীবনের শুরুতেই নববিবাহিতদের সংসার চালানো হয়ে পড়ে প্রায় অসম্ভব। শহরে চাকরিজীবী অনেক তরুণেরই গ্রাম বা শহরতলিতে নিজেদের অর্থাৎ বাবা-মায়ের বাড়িঘর রয়েছে। তারপরও চাকরির সুবাদে তাদের পড়ে থাকতে হয় শহরে, দরকার হয় ভাড়া বাসার। কর্মজীবনের শুরুর দিকে নিজের পয়সায় ফ্ল্যাট কেনা মধ্যবিত্ত ও নি¤œ-মধ্যবিত্তের পক্ষে সম্ভব নয়। আর নিশ্চিত একটি আশ্রয়ের অভাবেও দেরি করে বিয়ে করছেন অনেকে।
আবার অনেক বয়স হয়ে গেলেও উপযুক্ত সঙ্গীর অভাবে বিয়ে করছেন নাÑএমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। দিনে দিনে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সঙ্গী নির্বাচন নিয়ে দ্বিধা বাড়ছেই। এর সঠিক কারণ নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে হতে পারে, আধুনিক মানুষের মন অনেক বেশি পূর্ণাঙ্গ ও জটিল। আগেকার মানুষের তুলনায় মানিয়ে নেওয়া ও মেনে চলার প্রবণতা হয়তো কমেছে। আগের চেয়ে নারীরা যতটা স্বাধীনচেতা হয়েছে, সে তুলনায় পুরুষরা ততটা উদারমনা ও বিবেচক হয়নি। ফলে ভেঙে যাচ্ছে অনেক পরিবার। এটিও অনেক ক্ষেত্রেই বিয়েভীতি সৃষ্টি করছে এবং সঙ্গী নির্বাচনের ব্যাপারকে আরও কঠিন করে তুলছে।
এখনকার সময়ে লোক-দেখানো মানসিকতা অনেক বেশি চোখে পড়ছে। এটা অবশ্য বরাবরই ছিল। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন শুধু সম্পন্ন ঘরের মানুষরাই অতিরিক্ত খরচ করে বিয়ে উৎসব পালন করত। আর এখন এটি আচারে পরিণত হয়েছে। এখন তো তিন-চার দিনব্যাপী ধুমধাম করে বিয়ে না করলে যেন মানই থাকে না! যার সাধ্য আছে, তার কাছে এটি আনন্দের হলেও যাকে হিসাবের মধ্যে চলতে হয়, তার জন্য এটি বয়ে আনে বিরাট আর্থিক ঝুঁকি। অথচ কোনো এক অদ্ভুত কারণে এ প্রদর্শন মানসিকতা থেকে বের হতে পারছেন না নি¤œ-মধ্যবিত্ত ঘরের তরুণও। ফলে মোটা অঙ্কের দেনা করে বিয়ে করছেন তারা। আর বিয়ের পর সেই দেনা শোধ করতেই কেটে যাচ্ছে কয়েক বছর। ফলে সন্তান নেওয়ার জন্য আর্থিক প্রস্তুতি নিতে পারছেন না তারা।
সন্তান জন্মদান, এমনকি বিয়ে পর্যন্ত পিছিয়ে দিচ্ছে আধুনিক তরুণ-তরুণীর অতিরিক্ত অভাববোধ। সংসার শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তাদের চাই ঘরের আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও অন্যান্য সেবামূলক সুবিধা। অথচ আমাদের বাবা-মায়ের আমলে এসবের জন্য এত তাড়াহুড়ো ছিল না। তারা সময়ের সঙ্গে একে একে সংসার সাজিয়ে নিতেন। বর্তমান প্রজন্মের যারা মোটামুটি সচ্ছল বাবা-মায়ের সন্তান, তারা শৈশব থেকেই এসব সুবিধা পেয়ে অভ্যস্ত। ফলে এসব ছাড়া যে থাকা যায় বা এসব যে রাতারাতি হয় না, তা তারা মানতে চান না। কিন্তু চাইলেই তো সব আরাম-আয়েশ হাতের নাগালে পাওয়া যায় না। ধীরে ধীরে অর্জন করে নিতে হবে। তাই বলে জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেমে থাকবেÑএটা যৌক্তিক নয়। এ ব্যাপারটিই হয়তো মানতে পারছেন না অনেকে।
তারা নিজেদের আরাম-আয়েশের ব্যাপারে যেমন কম্প্রোমাইজ করতে চান না, তেমনি সন্তানের ব্যাপারেও অতিসাবধানী। এ সাবধানতা অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদিখ্যেতার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। বর্তমানে সন্তান জন্মদান ও প্রতিপালনের বিষয়টি অনেকের কাছেই অত্যধিক ব্যয়বহুল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শহরে চিকিৎসাসেবা ব্যয়বহুল এটা সত্য। বাণিজ্যিক স্বার্থান্বেষী হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো এর পেছনে অনেকাংশেই দায়ী। কিন্তু এর বাইরে মা-বাবাদেরও দায় রয়েছে কিছুটা। শিশুদের জন্য তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করেন। রাশি রাশি কাপড়চোপড়, খেলনা ও বিনোদনসামগ্রী দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে চান ছোট্ট শিশুটিকে। এতে তাদের মধ্যেও জন্ম নেয় বাড়তি অভাববোধ ও চাহিদা। অথচ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, শিশুদের বেশি বেশি কাপড়ে মুড়ে না রেখে সহনীয় মাত্রার খোলা আলো-বাতাসে রাখা ভালো। বিশেষ করে মায়ের সঙ্গে বেশি নৈকট্য, যাকে বলে ‘স্কিন টু স্কিন টাচ’ শিশুর বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধে খুবই প্রয়োজন। এছাড়া খেলনা ও বিনোদনসামগ্রীর চেয়ে নিকটজনের সান্নিধ্য ও যোগাযোগ শিশুর মানসিক বিকাশে বেশি সহায়ক। ফলে ভেবে দেখুন, বাচ্চাকে রাজপুত্র বা রাজকন্যার মতো প্রাচুর্য ও আহ্লাদে বড় করতে গিয়ে কি ভুলটা করছেন এখনকার বাবা-মা। আর এসব অপ্রয়োজনীয়, এমনকি ক্ষতিকর সামগ্রী কেনা সাধ্যে কুলাবে কিনাÑসে ভয়েই সন্তান নিতে কয়েক বছর দেরি করছেন অনেক দম্পতি।
তারপরও বিয়ে বা সন্তান গ্রহণে যুবসমাজের অন্তরায়গুলো অস্বীকারের উপায় নেই। সংসার গড়তে বেশি দেরি করায় জীবনকে যথাযথভাবে উপভোগ করতে পারছেন না তারা। বেশি বয়সে সন্তান ধারণে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকিও নেহায়েত কম নয়। এছাড়া চল্লিশের পর শিশুদের দেখভাল করাটাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। সন্তানের সঙ্গে তৈরি হয় প্রজš§ দূরত্ব। এতে পারিবারিক যোগাযোগ ও বোঝাপড়ায় সমস্যা হতেই পারে। এসব ক্ষেত্রে সন্তানের কৈশোর বয়সেই বৃদ্ধ হয়ে পড়েন বাবা-মা; মারা যান অনেকেই। চারপাশে তাকালেই হামেশাই চোখে পড়ে এ বাস্তবতা।
এ লেখার বক্তব্য এটি নয় যে, সবারই উচিত বয়স ত্রিশের মধ্যেই বিয়ে করে ফেলা বা বিয়ের দু’তিন বছরের মধ্যেই সন্তান গ্রহণ করা। আসলে একেকজনের জীবন একেক রকম। তাই জীবনের এসব সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রত্যেকের সঠিক সময়টাও ভিন্ন হবেÑএটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের সবারই এ সিদ্ধান্তগুলো আরও বেশি বাস্তবমুখী হওয়া উচিত। বর্তমানে সংসার গড়ায় পিছিয়ে যাওয়াটা যেমন একটি বাস্তবতা, তেমনি এর ক্ষতিকর দিকগুলোও আমলে আনা দরকার। এ দুটি দিকই ভারসাম্য করে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমরা কতটুকু প্রাপ্তির বিনিময়ে কতটুকু হারাচ্ছি। ভাবতে হবে, প্রাপ্তি ও ক্ষতির মধ্যে দূরত্ব কতটা। যা পাওয়ার জন্য ছুটছি, নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছিÑতা হয়তো একদিন পাওয়া যাবে। কিন্তু চলে যাওয়া সময় কি আর ফিরে আসবে?
গণমাধ্যমকর্মী