ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র অভিনয় ও প্রযোজনার ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন, যা ছিল প্রকৃতিগতভাবে ধ্রুপদী এবং চরিত্রগতভাবে স্বাদেশিক। বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথের লিখিত রূপের নাটকগুলোর সত্যিকারের পরিস্ফুটনের জন্য শম্ভু মিত্র পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
খুব সংগত কারণেই বাংলাদেশে তিনি নানা কারণে প্রাসঙ্গিক। তার কাজ নিয়ে এদেশে অনেক কাজ হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক নাট্যব্যক্তিত্ব ও নাট্যদল শম্ভু মিত্র দ্বারা প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত। সেই কথাগুলোই আগে বলা যাক। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের কয়েকটি নাট্যদল শম্ভু মিত্রের মৌলিক ও রূপান্তর-অনুবাদ নাটক মঞ্চে এনেছে। কণ্ঠশীলন ১৯৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি খালেদ খানের নির্দেশনায় মঞ্চে আনে শম্ভু মিত্রের রূপান্তর-অনুবাদ ‘পুতুল খেলা’ (মূল: হেনরিক ইবসেনের ‘ডলস হাউজ’); গণনাট্য কেন্দ্র ১৯৯৪ সালে খায়রুল বাসারের নির্দেশনায় মঞ্চে আনে শম্ভু মিত্রের মৌলিক নাটক ‘চাঁদ বণিকের পালা’ এবং এই একই নাটক আবার ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি জামাল উদ্দিন হোসেনের নির্দেশনায় মঞ্চে আনে নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল। এ সবকটি নাটকই আলোচিত হয়েছে এবং নাট্য-বোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এসবের বাইরেও তার কাজ নিয়ে বাংলাদেশে আরও কাজ হয়ে থাকতে পারে।
শম্ভু মিত্র কলকাতার রংমহল থিয়েটারের মাধ্যমে ১৯৩৯ সালে থিয়েটার ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি বামপন্থি আন্দোলনের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে আইপিটিএতে যোগ দেন। এখানে নাটকের আঙ্গিক নিয়ে তিনি অনেক কাজ করেন। বিজন ভট্টাচার্যের লেখা ‘নবান্ন’ নাটকে শম্ভু মিত্র প্রথম থিয়েটারের পুরোনো উপস্থাপনার ঢংটি ভেঙে তাতে নতুন আঙ্গিক যুক্ত করেন। ১৯৪৭ সালে আইটিপিএ’র কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর এর সদস্যরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে তাদের একটা নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তারা প্রত্যেকে নিজের মতো করে অপেশাদার বৃহত্তর থিয়েটার আন্দোলনে যুক্ত থেকে সমাজসচেতনতায় অবদান রেখেছেন। ১৯৪৮ সালে শম্ভু মিত্র প্রখ্যাত অভিনেতা ও স্বাধীনতার যোদ্ধা মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে ‘বহুরূপী’ গঠন করেন, যা এখন পর্যন্ত অনেক নাট্যব্যক্তিত্ব ও নাট্যদলের অন্যতম অনুপ্রেরণার নাম। এই নাট্যগোষ্ঠী নতুন ধরনের থিয়েটার আন্দোলনের সূচনা করে। শম্ভু মিত্রের নাটকগুলোতে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি তার নাটকগুলো সাধারণ দর্শককেও আলোড়িত করে। ‘বহুরূপী’ বিভিন্ন গীতিনাট্যও করেছে, রবীন্দ্রসাহিত্যের বিভিন্ন নাট্য-উপাদান খুঁজে বের করেছে এবং বাংলা নাট্যমঞ্চে ইবসেনের মতো সফোকিসকেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেক মানুষের রয়েছে একটি ব্যক্তিজীবন, একই সঙ্গে প্রত্যেকের থাকে একটি সামাজিক জীবনও। ‘বহুরূপী’র প্রযোজনাগুলোতে এই সত্য উম্মোচন ও এদের মধ্যকার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা লক্ষ করা যায়। ১৯৫৪ সালে ‘বহুরূপী’ কর্তৃক রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর মঞ্চায়ন বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এক মাইলফলক। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ এবং ‘রাজা’ও মঞ্চস্থ করে ‘বহুরূপী’। ক্যারিয়ারের শুরুতে শম্ভু মিত্র চলচ্চিত্র পরিচালনা ও অভিনয়ে সাফল্য পেলেও তিনি চলচ্চিত্রের রঙিন ও নিশ্চিত জগৎ ছেড়ে থিয়েটারের অনিশ্চিত পথে হেঁটে তার কর্মময় জীবন কাটিয়েছেন। শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট অব লিটারেচার, ম্যাগসাইসাই, পদ্মভূষণসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি সংগীত নাটক একাডেমির একজন ফেলো ছিলেন। চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনি কার্লোভিভারি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের গ্র্যান্ড-প্রিক্স পুরস্কার জিতে নেন।
শম্ভু মিত্র ১৯১৫ সালের ২২ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। এই নিবেদিতপ্রাণ নাট্যব্যক্তিত্বের আজ ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী।
