Print Date & Time : 5 September 2025 Friday 10:48 am

চীনের ঋণ কৌশল ও বৈশ্বিক স্নায়ুযুদ্ধ

শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান: বিশ্বরাজনীতিতে বহুল চর্চিত একটি কথা হচ্ছে নিজস্ব শক্তির গণ্ডি পার করতে বারংবার বৃদ্ধিতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। যে কৌশলগত ফাঁদে শক্তি সুদৃঢ় করার পাশাপাশি নিজেদের উপস্থিতি সর্বদা বজায় থাকবে সবসময়। বর্তমান বিশ্ব হয়ে পড়েছে অস্ত্রের ঝনঝনানি, সামরিক ক্ষেপণাস্ত্রের দাপটের ওপর। বলা হয়ে থাকে, সামরিক অস্ত্র কিংবা যুদ্ধের ওপর টিকে আছে বিশ্ব অর্থনীতি। কোনো দেশ কাউকে এক বিন্দু পরিমাণ ছাড় দিতে নারাজ তেমনি নিজেদের প্রভাব সর্বাংশে বজায় রাখতে সবসময় বদ্ধপরিকর পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলো। বিশ্বরাজনীতির এই ঘোলাটে ও মারপ্যাঁচে আটকা পড়ে অনুন্নত ও দারিদ্র্যযুক্ত দেশগুলো। আসলে প্রকৃত পক্ষে দরিদ্র দেশগুলোর তেমন কিছু করার থাকে না। তারা দেশের  অর্থনীতিকে সচল রাখতে উন্নয়নশীল ও প্রভাব বিস্তারকারী দেশগুলো থেকে সাহায্য যেমন ঋণ, নিরাপত্তা নিতে বাধ্য হয়। এই ঋণ নেয়াতে তাদের সাময়িক সুবিধা হলেও বাস্তবিকই সঠিক সময়ে এই ঋণ প্রদানে ব্যর্থ হলে দেশগুলোতে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়। বিশ্বরাজনীতির ময়দানে এটি একটি কৌশল। যার দ্বারা দেশগুলোকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখতে সক্ষম হয় ক্ষমতাধর দেশগুলো। মূলত পারমাণবিক শক্তি নির্ভর দেশগুলোর মধ্যকার এই পাল্টাপাল্টি কৌশল চলমান থাকে। কে কতখানি প্রভাব দেখিয়ে বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্র উত্তপ্ত ও ক্ষমতার রেশ  দেখাতে পারে তার হাতে থাকে বিশ্বরাজনীতির নাটাই। এর ফলে দেশগুলোর মধ্যে দুই পক্ষের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সরগরমের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধ আরম্ভ হয়। যার প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে শুরু করে দেশীয় অর্থনীতির কাঠামোতে।

চীন এশিয়ার সর্ববৃহৎ দেশ জনসংখ্যা ও আয়তন বিবেচনায়। তাছাড়া আয়তনে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হচ্ছে চীন। চীনের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি দেশ সীমান্তে সংযুক্ত রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। চীন চাইছে যে বৈশ্বিক মানচিত্রে নিজেদের ক্ষমতা বাড়াতে। বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের প্রথমে নিয়ে আসতে চীন মরিয়া হয়ে উঠেছে। অর্থনীতি, যোগাযোগ, অবকাঠামো ও সামরিক সরঞ্জাম প্রমুখ পরিপ্রেক্ষিতে চীন বিশ্বে দিন দিন নিজেদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়ায় বিশ্বের যেকোনো দেশই চীনকে অত্যন্ত সমীহ করে। চীন নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও বিশ্বে প্রভাবশালী দেশগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে নিত্য নতুন ছক কষছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্বের ৫০টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের তালিকায়  চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। মোট ১৯১টি দেশ নিয়ে তৈরি আইএমএফের এই তালিকায় প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে রয়েছে যথাক্রমেÑযুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও জার্মানি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত যুক্তরাজ্যকে ছাড়িয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে ষষ্ঠ থেকে পঞ্চম স্থান দখল করেছে। সর্বশেষ (১৯১তম) অবস্থানে রয়েছেÑ টুভালু। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ২০২২ সালে বিশ্ব অর্থনীতির আকার ১০০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে ১০১.৫৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।

বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নয়, সামরিক দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান খুব শক্তিশালী। চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিয়ে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে চাইছে। সেটা বিশ্বরাজনীতিতে কারও অজানা নয়, বরং এই চীনের এই বিষয় বর্তমানে বিশ্বরাজনীতিতে অত্যন্ত আলোচিত বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় চীন তাদের বৈদেশিক কৌশল ও সামরিক খাতে ভিন্ন মাত্রা এনেছে। তার মধ্যে একটি কৌশল হচ্ছে ঋণ কৌশল। যে কৌশলের দ্বারা চীন সহজে একটি দেশকে বিভিন্ন শর্তে সময় বেঁধে দিয়ে বিপুল ঋণ প্রদান করে। এতে ওই দেশের সঙ্গে চীনা অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়। কিন্তু যে দেশটি ঋণ নেয় ওই দেশটি নির্দিষ্ট সময়ের সঙ্গে ঋণ প্রদানে ব্যর্থ হয়। তখন  দেশটির কোনো উপায়ন্তর থাকে না। কারণ ঋণের সুদাসলের পরিমাণ বেশি হওয়া। সেক্ষেত্রে দেশটি ঋণ শোধ করতে চীনের চাহিদা অনুযায়ী যাবতীয় সুযোগ গ্রহণ সৃষ্টি করে দেয়। এটিই হচ্ছে চীনা ঋণ কৌশল। ফলে ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ কথাটি এখন উন্নয়ন ডিসকোর্সে পরিণত হয়েছে।

চীন  বিশ্বব্যবস্থাপনায় নিজেদের আধিপত্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রধানত মহাসড়ক, রেলপথ, গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ–্যৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট, খনিজ আহরণ প্রকল্প ইত্যাদি ভৌত অবকাঠামোতে সহজ শর্তে যে বিপুল ঋণ প্রদান করছে, তাতে বেশির ভাগ দেশ প্রলুব্ধ হয়ে এমন সব প্রকল্পে এই ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করছে। কিন্তু এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক ভিত নড়বড়ে হওয়ায় প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পরও প্রকল্প থেকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণ ও আয় হচ্ছে না। এতে দেশগুলো সুদাসলে চৈনিক ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে এসব দেশ একের পর এক চৈনিক ঋণের ফাঁদে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকা পড়ে ওই প্রকল্পগুলোর দীর্ঘমেয়াদি কর্তৃত্ব চীনকে অর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে, অথবা চীনকে নিজেদের সার্বভৌমত্ববিরোধী নানা সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে।

পাকিস্তানের চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপেক বা সিপিইসি) ও গোয়াদার গভীর সমুদ্রবন্দর, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর ও কলম্বো চায়নিজ সিটি, মালদ্বীপের আন্তঃদ্বীপ যোগাযোগ সেতু, মিয়ানমারের কিয়াকফ্যু গভীর সমুদ্রবন্দর ও তেল-গ্যাস পাইপলাইন এগুলো চীনা ঋণের ফাঁদের উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে সামনে আসছে। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, যা সম্পর্কে পুরো বিশ্ব অবগত। অবকাঠামোকে মূল প্রাধান্য দিতে গিয়ে শ্রীলঙ্কা আজকের এ দুরবস্থার জন্য দায়ী। তার মধ্যে জড়িয়ে আছে চীনের ঋণ। শ্রীলঙ্কা চীনের কাছে যে ঋণ নিয়েছে তা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় শ্রীলঙ্কা হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দরকে চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিতে বাধ্য হয়। চীনের কাছে জিবুতি, লাওস, জাম্বিয়া এবং কিরগিজস্তানের ঋণের পরিমাণ তাদের বার্ষিক মোট জাতীয় উৎপাদনের ২০ শতাংশের সমান। চীনের কাছ থেকে নেয়া এসব ঋণের বেশিরভাগই বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য নেয়া, যার মধ্যে রয়েছে সড়ক, রেলওয়ে এবং বন্দর নির্মাণ। অধিকাংশ ঋণই দেয়া হয়েছে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায়। গত এক দশকে নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে দেয়া চীনের ঋণের পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত কয়েক দশকে বিশ্বরাজনীতিতে দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রভাব বিস্তার করে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের গণ্ডি পেরিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রবল। একই ক্ষেত্রে চীনও এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে নিজেদের উপস্থিতি বিস্তৃত করতে চাইছে সর্বমহলে। সেজন্য তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় ঋণ কৌশলকে অন্যতম মুখ্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে গত কয়েক বছর। ঋণ কৌশলকে ব্যবহারের মাধ্যমে চীন বিভিন্ন দেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ করে নিচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চীনের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে।

এখন চীনা এই ঋণ অন্য দেশগুলোর জন্য কীভাবে আর্তনাদ ও গলার ফাঁস হয়ে যাচ্ছে তার কারণে উঠে এসেছে উচ্চ সুদে সহজে ঋণ প্রদান করা। সাধারণত বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)সহ উন্নয়নশীল দেশগুলো যে ঋণ প্রদান করে অন্য দেশকে। নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া ও নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে সেই ঋণ পেতে যেকোনো দেশকে কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু বেইজিং যে ঋণ প্রদান করে সেখানে সুদের হার থাকে তার থেকেও বেশি। কিন্তু  সহজে ঋণ প্রদান করে দেশটিকে। এতে চীনের এই ঋণ কৌশল বা ফাঁদে আগ্রহী হয়ে যেকোনো দেশ ঋণ গ্রহণ করে। কিন্তু তা দেশগুলোর জন্য সুখকর কিছু বয়ে আনে না। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে অন্যান্য দেশের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান ঋণ কর্মসূচির তুলনামূলক একটি চিত্র পাওয়া যায়। পশ্চিমা দেশের সরকার যত সুদে ঋণ দেয় চীন তার চাইতেও বেশি সুদে ঋণ দেয়। তাদের সুদের হার প্রায় ৪ শতাংশ, যা বাণিজ্যিক বাজারগুলোর সুদের হারের প্রায় সমান। তাছাড়া চীন যে ঋণ প্রদান করে তা গ্রহীতা দেশকে শোধ করতে হয় দশ বছরের মধ্যে, যা খুব কম সময় গ্রহীতা দেশগুলোর জন্য।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চীন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাবে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যার ফলাফল স্নায়ুযুদ্ধে রূপ নেয় দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হরহামেশাই বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চীনের ওপর। চীনও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। তাছাড়া চীনের সঙ্গে যে দেশের দ্বন্দ্ব বিবাদ রয়েছে। যেমনÑ তাইওয়ান প্রণালিতে তাইওয়ানের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব^ বহু পুরোনো। কিন্তু তাইওয়ানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে বন্ধুপ্রতিম সম্পর্ক। তাইওয়ানের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এতে সামরিক ক্ষমতার দাবানলে উত্তপ্ততর হয় বিশ্ব রাজনীতির ব্যবস্থাপনায়। আসলে চীনের ঋণমুখী বৈদেশিক কৌশল ও নৈমিত্তিক চর্চা ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে রাজনীতির ময়দানে। তা বিশ্ববাসীর জন্য কতটুকু লাভজনক সেটাই মূল বিবেচ্য।

শিক্ষার্থী

সমাজকর্ম বিভাগ

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়