বর্ণ বা অক্ষরের উৎপত্তি শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

পৃথিবীতে মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। সারা পৃথিবীতে মোট ভাষার সংখ্যা ৭০৯৯টি। প্রতিটি ভাষাই একটি নির্দিষ্ট চিহ্ন দিয়ে লেখা হয় যাকে বর্ণমালা বলে। মানুষ যে ধ্বনি উচ্চারণ করে মনের ভাব প্রকাশ করে তা বর্ণ বা অক্ষর দিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়। পৃথিবীতে ব্যবহূত ভাষাগুলোর লিপিবদ্ধতার বর্ণ বা অক্ষর কবে বা কোন ভাষার বর্ণ বা চিহ্ন প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছে তা নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না যে অমুক ভাষার বর্ণ বা অক্ষর পৃথিবীতে প্রথম প্রচলন ঘটে। তবে নানা ধারণাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে একটি ঐকমত্য পোষণ করা যায় যে, প্রাচীনকাল হতে পাঁচটি স্তর পার হয়ে আধুনিক বর্ণমালা বা অক্ষরমালা এসেছে। পৃথিবীতে যখন কোন বর্ণ বা অক্ষরমালা ছিল না, তখন মানুষ গাছপালা-মানুষ-প্রাণীর ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করত। এটা হচ্ছে বর্ণমালার প্রথম স্তর যাকে গ্রন্থিলিপি বলা হয়। আনুমানিক ১৫ কি ২০ হাজার বছর আগে মানুষ গ্রন্থিলিপি দ্ধারা মনের ভাব প্রকাশ করত।

এই বিষয়টিকে একটু সংক্ষেপে করার জন্য মানুষ মনের ভাব প্রকাশে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার শুরু করে। তখন সম্পূর্ণ ছবি না একে সংকেত বা চিহ্ন বা প্রতীকের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করা শুরু করে। একে ভাবলিপি বলা হয়। ভাবলিপিটা ছিল এমন, তা হলো দিন বুঝাতে সূর্য আঁকত, রাত বুঝাতে অর্ধবৃত্তের সঙ্গে তারা একে রাতকে প্রকাশ করত। তার পরবর্তী পর শুরু হয় চিহ্ন দ্ধারা বিভিন্ন শব্দকে বুঝানো। যাকে শব্দ লিপি বলা স্তর বলা হয়। একে পর্যায়ে এসে শব্দ লিপির চিহ্নগুলোকে আরেকটু সংক্ষেপে করে প্রকাশ করতে শুরু করে যাকে চতুর্থ স্তর বলা হয়। এই সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা চিহ্নকে বলা হত অক্ষরলিপি। পরবর্তী সময়ে অক্ষরলিপির চিহ্নগুলোকে একটু সুন্দর নকশায় রং ও বর্ণ দিয়ে লেখা শুরু হয়, সেই সময় এটা বলা হয় ধ্বনিলিপি। এই ধ্বনিলিপি থেকে আধুনিক বর্ণমালার উৎপত্তি। আর এই চিহ্নগুলোকে বর্ণমালা বা বর্ণ হিসেবে বিবেচিত করা হয়।

বর্ণমালা বির্বতনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা যায়, একটি হলো সেমিটিক ভাষী মানুষ, সম্ভবত ফিনিশিয়ানরা ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীরে খ্রিষ্ট জন্মের প্রায় দুই হাজার বছর আগে ব্যঞ্জনবর্ণ লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার হয়েছিল উত্তর সেমিটিকে। দ্বিতীয়টি আবিষ্কার হয়েছিল গ্রিক দ্বারা, এটা ছিল স্বরবর্ণের প্রতিনিধিত্ব করা অক্ষর আবিষ্কার করে। এই আবিষ্কারটি হয়েছিল খৃষ্ট জন্মের প্রায় ৮০০ থেকে ৭০০ বছর আগে। কিছু পণ্ডিত সেমেটিক লিখন পদ্ধতিকে একটি অবাঞ্চিত পাঠ্যক্রম এবং গ্রিক পদ্ধতিকে প্রকৃত বর্ণমালা মনে করেন। তবে উভয়টিকে বর্ণমালার রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বর্ণমালার উৎস হিসেবে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা হয়েছে। গ্রিক ও রোমানরা পাচটি ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে বর্ণমালার সম্ভাব্য উদ্ভাবক হিসেবে বিবেচনা করেছিল। তারা হলো ফিনিশিয়ান, মিশরীয়, অ্যাসিরিয়ান, ক্রেটান ও হিব্রু। আধুনিক গবেষণায় যা পাওয়া যায় তা প্রাচীন তত্ত্বের সঙ্গে খুব বেশি পাথর্ক্য নয়। যদিও লক্ষণগুলোর বাহ্যিকপে উপেক্ষা করা হয় এবং শুধুমাত্র ধ্বনিগত মান, সংখ্যা এবং ক্রম বিবেচনা করা হয় তা হলে হিব্রু বর্ণমালা প্রাচীন। কিছু পণ্ডিতরা হিব্রু ক্রমটিকে প্রাচীন হিসেবে মনে করেন। যা ৩ হাজার ৫০০ বছর আগে আধুনিক রুপ নিয়েছিল। হিব্রু বর্ণমালাকে পদ্ধতিগত ভাবে প্রাচীন কালে শেখানো হতো তার প্রমানটি পাওয়া যায় দক্ষিণ ইসরায়েলের তেল লাখিশের প্রসাদে। তেল লাখিশের প্রসাদের দিকে যেতে সিড়ির উপরে পাচটি অক্ষরে ক্র্যাচ করা । তা ছিল হিব্রু অক্ষর ।
আরমাইক ভাষার সঙ্গে উত্তর সেমেটিক বর্ণমালার অভিযোজন ঘটেছিল খৃষ্ট জন্মের ১০ শতক বছর পুর্বে। যখন উত্তর মেসোপটোমিয়া এবং সিরিয়ার কয়েকটি ক্ষুদ্র রাজ্যর মানুষ আরামাইক ভাষায় কথা বলত। যার মধ্যে অন্যতম দামেস্ক ও মধ্যপ্রাচ্য। সামগ্রিক ভাবে যে কয়েকটি আরামিক শিলালিপি পাওয়া গেছে তা ৭তম থেকে ৯ম শতাব্দীর মধ্যে। ষষ্ঠ শতাব্দীর কিছু শিলালিপি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, মধ্য প্রাচ্যে আরমাইক বর্ণমালার দ্রুত বিস্তার ঘটে। আরামাইক প্যাপরি এবং অষ্ট্রাকা (লিখিত মৃৎপাত্রের টুকরো) এগুলোতে যে তারিখ উল্লিখিত তা খ্রিষ্ট জন্মের ৫১৫ বছর আগের। এলিফ্যান্টাইন প্যাপরিতে দেখা যায়, হিব্রু সামরিক ও ধর্মীয় উপনিবেশের তথ্য। সেখানে হিব্রু জাতির অর্থনৈতিক তথ্য রয়েছে। উত্তর আরব, প্যালেষ্টাইন, লিবিয়া, ক্যাপাডোসিয়া, লিডিয়া, সিলিসিয়া, অ্যাসিরিয়া, গ্রিস, আফগানিস্তান এবং ভারত পর্যন্ত আরামাইক শিলালিপি পাওয়া গেছে। সিরিয়ার পশ্চিমে সব বর্ণমালার লিপিগুলো উৎপত্তি হয়েছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কেনানাইট বর্ণমালা থেকে। এখানে শত শত বর্ণমালার লেখা দৃশ্যত আরামাইক বর্ণমালার শাখা থেকে উদ্ভূত। সামগ্রিকভাবে, আরামাইক বর্ণমালার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বংশধরদের দুইভাবে বিভক্ত করা যায়। একটি সেমেটিক ভাষার জন্য লিপি, অন্যটি অসেমেটিক ভাষায় অভিযোজিত। মেসেটিক শাখাটির ক্ষেত্রে, ছয়টি বর্ণমালা শনাক্ত করা যায়, যেমন- হিব্রু, নাবাতিয়ান-সিনাইটি, আরবি-পালিমারিণ, সিরিয়াক-নেষ্টুরিয়ান, ম্যান্ডিয়ান এবং ম্যানিচিয়ান। এর মধ্যে কিছু বর্ণমালা আরামাইক বর্ণমালা এবং মধ্য, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় অসেমেটিক ভাষার জন্য ব্যবহূত লিপির মধ্যে যুগ সূত্র গড়ে ওঠে। প্রত্যক্ষ বা প্রধানত পরোক্ষভাবে আরামাইক বর্ণমালা থেকে অ-সেমেটিক ভাষার সঙ্গে অভিযোজিত হয়েছিল যে বর্ণগুলোর সেই ভাষাগুলো হলো, ফার্সি:- ইরানি স্ক্রিপ্ট হিসেবে পরিচিত পাহলভি, যা প্রাক ইসলামিক ফার্সি সাহিত্যের মতো লেখার জন্য ব্যবহূত হয়েছে। সোগদিয়ান:- একটি লিপি এবং ভাষা যা প্রথম সহস্রাব্দে দ্বিতীয়ার্ধে মধ্য এশিয়ার ফ্রাঙ্কো ভাষা গঠন করেছিল। কোক তুর্কী: মধ্য সাইবেরিয়ার দক্ষিণ অংশে, উত্তর পশ্চিম মঙ্গোলিয়ায় এবং উত্তর পূর্ব তুর্কিস্থানে বসবাসকারী তুর্কি উপজাতিদের দ্ধারা ৬ষ্ট থেকে ৮ম শতাব্দির মধ্যে ব্যবহূত একটি লিপি (এই বর্ণমালাটি প্রাথমিক হাঙ্গেরিয়ান বর্ণমালার নমুনা ছিল)। উইঘুর বর্ণমালা, একটি তুর্কি ভাষী মানুষ যারা ১৩ শতাব্দির প্রথম দিকে মঙ্গোলিযার ও পূর্ব তুর্কিস্থানে বসবাস করত। এই লিপিটি তিব্বতীয় প্রভাবের সঙ্গে অভিযোজিত হয়েছিল। মঙ্গোল সাম্রাজ্যের লেখা হিসেবে গৃহিত হয়েছিল কলিকালিপি। কাল্মিক, বুরিয়াট, মঙ্গেলিয়ান প্রপার এবং সহযোগী মাঞ্চু বর্ণমালার সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে মঙ্গোলদের বর্ণমালার জন্ম হয়। আরামাইক বর্ণমালা সম্ভবত ভারতের ব্রাহ্মীলিপির নমুনাও ছিল। একটি প্রায় ভারতীয় সব অঞ্চলের লেখার মূল হয়ে ওঠে।
বাংলা বর্ণমালা এসেছে প্রাচীন ভারতীয় ব্রাহ্মীলিপি থেকে। তাছাড়া বাংলালিপি ও অক্ষর উদ্ভব হয়েছে ব্রাহ্মী লিপি মাধ্যমে। ব্রাহ্মী লিপি ভারতীয় উপমহাদেশে একটি প্রাচীন লিখন পদ্ধতির নাম। এটি একটি শব্দীয় বর্ণমালা রীতি, যেখানে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ আলাদা হয়েছিল। ব্রাহ্মীলিপি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করে সম্রাট অশোকের আমলে। সম্রাট অশোকের আমলের পাথর খোদাই করা বালীতে ব্রাহ্মীলিপির সন্ধান পাওয়া যায়। আর এই ব্রাহ্মীলিপির থেকে বাংলা বর্ণের উৎপত্তি ঘটে। প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত জ্ঞান সম্পন্ন ব্রাহ্মলদের দ্ধারা এই লিপি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে একে ব্রাহ্মীলিপি বলা হয়। সংস্কৃত বর্ণমালার সেমেটিকএর অভিযোজনাংশ।
ব্রাহ্মীলিপি উত্তরী ও দক্ষিণী দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তরীলিপি গুলির মধ্যে প্রচলিত ছিল চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বদেশীয় গুপ্তলিপি। এই গুপ্তলিপি থেকে ষষ্ঠ হতে নবম শতাব্দীতে আবিভার্ব হয় কুটিল লিপি বা সিদ্ধ মাতৃকা লিপির।
সিদ্ধ মাতৃকালিপির পরির্বতন হয়ে জন্ম দেয় প্রটো বাংলা লিপির। এই লিপিতে বাংলালিপির বর্তমান চেহারার প্রথম সাদৃশ পাওয়া যায়। তাই একে বলা হয় প্রটো বাংলা বা গৌড়লিপি। ওই সময় যে বর্ণগুলো ছিল তার চেহারা বর্তমান বাংলার হুবহু মিল পাওয়া যায়, যা আমরা ব্যবহার করি , যেমন- ঈ, ঈ, উ, ঊ, ট র্বণগুলো— তবে ওই সময় এই বর্ণগুলোর ওপরের লেজ ছিল না।
গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের সপ্তম শতকে যোগ চিহ্নের মতো ক বর্ণটি ত্রিকোনার রূপ নেয়। ডান দিকে বক্ররেখা যুক্ত হয় যা বাংলা ‘ কৃ বর্ণের প্রাথমিক রূপ ধরা পড়ে। আবার ব্রাহ্মীর ‘র’ বর্ণটি ছিল একটি উল্লম রেখার মত। এই যুগেই ‘র’ বর্ণটি ত্রিকোনা রুপ লাভ করে। তবে ‘র’ এর নিচে সেই সময়কার কোন বিন্দু দেখা যায় নাই। ‘থ’ এর মধ্য ভাগটি একটু স্ফিত হয়এবং শির ভাগে একটি পুটলি দেখা যায়। অনুরূপ ফ এর ডান দিকে একটি পুটলি যুক্ত হয়ে ফ র্বণটির উদ্ভব হয়। নাগরী লিপি বা উত্তর নাগরী লিপি হলো দেবনাগরীর রূপের পূর্ব পুরুষ, বাংলা লিপিতে উত্তর ভারতীয় নাগরী লিপির প্রভাব পড়ে। এর ফলে পূর্ব ভারতীয় লিপি নতুন চরিত্র লাভ করে। একে লিপি বিদ্যাবিশারদগন ‘প্রাটো-নাগরী’ লিপি বলে অভিহিত করেছেন। এ সময় লিপি পরির্বতনের মূলে ছিল পাল রাজবংশের শাসনকাল। পাল রাজবংশের শাসকাল ছিল ৭৫০ থেকে ১১৬১ সাল পর্যন্ত।
সেন যুগের প্রথম —///////////দিকে বাংলালিপির বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপটি লক্ষ করা যায়। বিজয় সেন বল্লাল সেনের শাসনামলে পাণলিপি ও তাম্রলিপিতে প্রোটো-বাংলার বহুল প্রচলন ছিল। ঐ সময় বহু বর্ণ অবিকল বাংলার বর্তমান বর্ণের ন্যায় লেখা হতে থাকে।‘ই’, ‘ঈ’, ‘উ’, ‘ঊ’, ‘ট’ এই ধরনের র্বন গুলি আলংকারিক উড়ি ছাড়া অবিকল বর্তমান বাংলা বর্ণের মত ছিল। তবে সেন ও চন্দ্র লিপি মালায় ঈ বর্ণের ব্যবহার দেখা যায়। চ বর্ণটি প্রোটো বাংলায় নতুন রুপে পরির্বতিত হয় এর আগে চ বর্ণের বক্রাকার রেখাটি বাম দিকে ছিল। কিন্তু প্রোটো-বাংলায় তা ডান দিকে চলে আসে। এছাড়া প্রোটো-বাংলায় ক্ষ, ঙ্গ,ঞ্জ,চ্ছ,ঞ্চ, যুক্তাক্ষরগুলো বাংলা অক্ষরের খুব কাছাকাছি অবস্থান করতে থাকে। লক্ষন সেনের আনুলিয়া তাম্র শাসনে বাংলা লিপির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। বিশ্বরুপ সেনের সাহিত্য পরিষৎ এর লিপিতে বাংলা লিপির ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পায়। ডোম্মনপালের সুন্দরবন তাম্র লিপিটি প্রায় পুর্ণাঙ্গ বাংলা অক্ষরে উৎর্কীণ। যার সময়কাল ১১৯৬ সাল। বারো শতকের পর আর কোন বাংলা তাম্র লিপি পাওয়া যায়নি ,তবে তের শতকের মাঝামাঝি থেকে সতেরো শতক পর্যন্ত বাংলা পা্লুলিপি পাওয়া যায়। এসব পা্লুলিপিতে বাংলা পা্লুলিপির পুর্ণাঙ্গরুপ ক্রমশ ষ্পষ্ট হয়ে উঠে। খালিমপুর তাম্রলিপি , দেবপালের মুঙ্গের তাম্র শাসন এবং প্রথম মহীপালের সারানাথ লিপিতে “প্রোটো-নাগরীর” লিপির প্রচলন দেখা যায়। ময়মনামতি আদিবে রাজাদের লিপিতে ও চন্দ্রলিপিতে প্রোটো-নাগরী লিপির প্রভাব প্রতিফলিত হয়। ৯ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে দশম শতক পর্যন্ত সারা বাংলায় জুড়ে, তখন প্রোটো- বাংলার ব্যাপক প্রচলন ছিল। মহীপালের বানগড় লিপি , নারায়নপালের গরুড় স্তম্ভলিপি এবং বিগ্রহপালের আমগাছি লিপিতে প্রটো-বাংলার লিপির ব্যবহার করা হয়। পাল যুগের পা্লুলিপি “অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা এবং সন্ধাকর নন্দীর রাম চরিত গ্রন্থে যে লিপি ব্যবহার করা হয় তা ছিল প্রোটো-বাংলা।
মুকুন্দরামের চ্লীমঙ্গল কাব্যে যে চিত্রটি পাওয়া যায় তা হলো, শ্রীমন্তের শিক্ষারাম্ভ থেকে ষোড়শ শতকের বাংলায় শিশু শিশু শিক্ষার সুচনাপর্ব। পাঁচ বছরের শিশুকে গুরুর পাঠশালায় হাতে খড়ি দেয়া হত। এই পাঠশালায় শিশুরা গুরুর কাছ থেকে মুখে মুখে হাতে লেখা পুথি থেকে নীতি, জমিজমা ও ব্যবসা সংক্রান্ত হিসাব নিকাশ , বাক্য, শ্লোক ইত্যাদি মুখস্ত করত। তখনো মুদ্রন যন্ত্র বাংলায় স্থাপিত হয়নি, আর একটি বিষয় তখন লক্ষ্য করা যায় যে , ইংরেজদের আবিস্কৃত মুদ্রন যন্ত্রে বাংলার ব্যবহার করলে তা হবে জাত যাওয়ার শামিল । তবে এই কুসংস্কারটি কেটে যায় অল্প সময়ের মধ্যে। রাধাকান্ত্র দেব রচিত বাঙ্গালা শিক্ষা গ্রন্থে বর্ণমালা , ব্যাকরণ , ইতিহাস, ভুগোল , গনিত ইত্যাদি বিষয়ের সমাবেশ ঘটে। এই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮২১ সালে। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ২৮৮। এত বড় বইটি প্রাথমিক বা শিক্ষা জীবন শুরুর জন্য উপযুক্ত ছিল না।
বাংলা ভাষায় বাঙালির শিক্ষা দিক্ষার পটভুমি বিচার করলেই বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় বইটি ষ্পষ্ট হয়ে উঠে। শিশুদের বর্ণ পরিচয় রচনার গোড়ায়ই এসে পড়ে বর্ণমালার কথা। ব্রাহ্মীলিপি থেকে বিবর্তিত হয়ে বাংলা বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে। এই বির্বতন প্রক্রিয়া চলে প্রায় তিনহাজার বছরও বেশী সময়কাল। তবে এটা সর্বজন স্বিকৃত যে বিদ্যাসাগরের হাতেই বাংলা বর্ণের যথাযথ উন্নতি হয়েছে। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা বর্ণমালার যে মৌলিক উন্নয়ন ঘটেছে তার প্রায় দেড়শত বছর একই ভাবে চলেছে। তবে এই সময়কালে সামান্য কিছু সংস্কার করা হয়। বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালার প্রকৃতি ও সংখ্যা নির্ধারন করেন। ১৭৬৮ সালের হালহেডের বইয়ের স্বর বর্ণের সংখ্যা ছিল ১৬ টি। পরবর্তীতে প্রায় একশত বছর মদনমোহনের শিশু শিক্ষা প্রথম ভাগে স্বরবর্ণের সংখ্যা ছিল ১৬ টিই। এগুলো হলো অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ৠ, ঌ, ৡ, এ, ঐ, ও, ঔ, অ৽, অঃ। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এই সংখ্যা কমিয়ে ১২ টিতে নামালেন। তিনি তার এই কমানোর ভুমিকায় লিখেছিলেন“ বহুকালবধি বর্ণমালায় ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষায় দীর্ঘ ৠ-কার ও দীর্ঘ ৡ-কারের প্রয়োজন নাই। এই নিমিত্তে এই দুইটি র্বণ বাদ দেয়া হয়েছে। আর সবিশেষ অনুস্বার ও বিসর্গ স্বর বর্ণের মধ্যে পরিগণিত হতে পারে না। তাই এই বর্ণ গুলি ব্যঞ্জন বর্ণে পঠিত হয়েছে। চন্দ্র বিন্দু ব্যঞ্জনবর্ণের স্থলে স্বতন্ত্র বর্ণ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। ড,ঢ,য এই তিন বর্ণের ব্যঞ্জন বর্ণে পদের মধ্যে অথবা পদের অন্তে থাকিলে ড়,ঢ়,য় হয়। বিদ্যা সাগরের মৌলিক সংস্কারের পর ১২৫ বছরে মাত্র একটি সংস্কার করা হয়েছে । তা হলো স্বরবর্ণ থেকে ঌ বর্ণটি বাদ দেয়া হয়েছে। এথন স্বর বর্ন ১১ টি ব্যঞ্জন বর্ন ৩৪টি। বিদ্যাসাগর তাতে নতুন করে ছয়টি বর্ন যুক্ত করেন। অনুস্বার বিসর্গ স্বর বর্ন থেকে ব্যঞ্জন বর্ণে এনে তার সঙ্গে চন্দ্রবিন্দু যোগ করে দিলেন। তাছাড়া ড, ঢ, য বর্ণের দ্ধিবিধ উচ্চারনের জন্য নিচে ফুটকি বা শুণ্য জুড়ে দিলেন। এতে তিনটি ব্যঞ্জন বর্ণের আবিষ্কার হল। তাছাড়া বিদ্যাসাগার বাংলা ভাষা আকারে ত ,ৎ দ্ধিবিধ কলেবরে প্রচলিত আছে তাই ৎ কে ব্যঞ্জন বর্ণে সংযুক্ত করেন। যেহেতু ক্ষ অক্ষরটি ক ও ষ এর মিলনে হয় তাই তিনি ব্যঞ্জবর্ন থেকে ক্ষ অক্ষরটি বাদ দিলেন। এভাবে বিদ্যাসাগারের হাতে ব্যঞ্জবর্ণ হলো ৪০ টি। এর মধ্যে স্বরবর্ণের ঌ এর মত শুধু অন্তস্থ ব বর্ণটি বাদ দেয়া হয়। এখন ব্যঞ্জন বর্ন ৩৯ টি।
নানা তথ্য উপাত্ত অনুসারে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এভাবেই বর্ণ বা অক্ষরের উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রনে।

উন্নয়নকমী, মুক্ত লেখক
কাদিরগঞ্জ দরিখোরবোনা, রাজশাহী