নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : রোজা আসতে এখনো কয়েক মাস বাকি, কিন্তু তার আগেই রাজধানীর মানুষ যেন ভোগান্তির ইঙ্গিতে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছে। প্রতিদিনকার বাজারের থলে এখন যেন শুধুই কাঁদে-একটার পর একটা পণ্যের দাম বাড়ছে। এবার সেই তুালিকায় যোগ হলো ফলও। বিশেষ করে আমদানিকৃত ফলের বাজার যেন আগেভাগেই রোজার নামে কষতে শুরু করেছে বাড়তি দাম। ক্রেতার কপালে ভাঁজ, অথচ সিন্ডিকেটের খেলা থামার লক্ষণ নেই। রোজার আগে সাধারণ মানুষের ফলের থালা থাকবে কী, না থাকবেই বা কতটাÑ এ প্রশ্ন এখন ভর করছে নগরবাসীর মনে।
সরবরাহ সংকটের অজুহাতে পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় খুচরা বাজারেও কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৬০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফল। তবে দেশি ফলের বাজার এখনও স্থিতিশীল।
রাজধানীর মগবাজার, মালিবাগ, রামপুরা, খিলগাঁও, মতিঝিল টেলিফোন কলোনি, শাহজাহানপুর এবং সেগুনবাগিচা এলাকার বিভিন্ন ফলের দোকানে গতকাল শনিবার দেখা গেছে- আপেল, আঙুর, কমলা, আনারসহ আমদানি করা বেশিরভাগ ফলের দাম আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাজারে প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৩০ টাকা, কমলা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা, ছোট কমলা ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি, সবুজ আপেল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি, লাল আপেল ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি, নাশপাতি ৩০০ থেকে ৩৩০ টাকা কেজি, আনার ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা কেজি, তুলনামূলক ছোট আঙুর ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি এবং পারসি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকায়।
তবে দেশি ফল না হলেও দেশেই চাষ হচ্ছে ড্রাগন। এ ফলটির দাম বেড়েছে কেজিতে প্রায় ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে প্রতি কেজি ড্রাগন বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা। তুলনামূলক ছোট ড্রাগনগুলো বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা।
বর্তমান বাজারে এক কেজি পেয়ারা বা পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়, দেশি মাল্টা ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, আমড়া ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, আমলকী ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, জলপাই ৮০ থেকে ১০০ টাকা। আনারস মিলছে প্রতিটি ৩০ থেকে ৪০ টাকায়, এক হালি লেবুর দাম ২০ থেকে ৪০ টাকা।
মগবাজারের এক খুচরা ফল বিক্রেতা বলেন, ‘পাইকারি বাজারে আমদানি করা সব ধরনের ফলের দাম কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। একইসঙ্গে কিছু ফলের ঘাটতিও তৈরি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে রোজার আগে আরও দাম বাড়তে পারে।’
খিলগাঁওয়ের এক দোকানি বলেন, ‘ফল সরবরাহে গরমিল হচ্ছে। রোজার সময় ফলের চাহিদা বাড়বে তখন দাম তো বাড়তেই পারে।’
এদিকে ক্রেতারা বলছেন, সবই সিন্ডিকেটের কারসাজি। বাজারে ফলের ঘাটতি নেই, তবুও সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন বিক্রেতারা। রোজার আগে দাম বাড়ানোর এই প্রবণতা এখনই নিয়ন্ত্রণ না করলে, রোজার মাসে ফল ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
শাহজাহানপুর বাজারে ফল কিনতে আসা এক গৃহিণী বলেন, রোজা আসতে এখনও অনেক দেরি। এরই মধ্যে ফলের দাম বেড়েছে। ধরেই নেয়া যায়, সামনে আরও বাড়বে। এখনই বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ না করলে রোজায় ফল সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
ঢাকার প্রধান আড়তগুলোর মধ্যে বাদামতলী অন্যতম। বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ীরা জানান, খেজুর বাদে দেশে বছরে দুই থেকে আড়াই লাখ টন ফল আমদানি করা হয়। আর খেজুর আমদানি করা হয় ৮৫ থেকে ৯০ হাজার টন। এই বাজারে মাল্টা, আপেল, কমলা, আঙুরের মতো কিছু ফল সারা বছরই পাওয়া যায়। দেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় মাল্টা। বেশির ভাগ মাল্টা আসে মিসর, দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীন থেকে। এরপর বেশি আমদানি হয় আপেল ও কমলা। এই দুটি ফল বেশি আসে চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত থেকে। আর আঙুর বেশি আসে চীন ও ভারত থেকে। দেশে আমদানি করা মোট ফলের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই এই চার ফলের দখলে।
এছাড়া ভারত ও মিসর থেকে বেদানা, চীন থেকে নাশপাতি আসে। আবার অ্যাভোকাডো, চেরি প্রভৃতি ফলও এ বাজারে পাওয়া যায়। এগুলো অবশ্য আকাশপথে বেশি আসে। আর সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে খেজুর আমদানি করা হয়। মৌসুমভেদেও ফলের ভিন্নতা থাকে। যেমন, মাল্টার কথা ধরা যাক। বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে মাল্টা আসে মিসর থেকে। আবার জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এবং আগস্ট থেকে অক্টোবর মাসে ভারত থেকে মাল্টা আসে।
বাদামতলী বাজারে পাইকারিতে এক কার্টন মাল্টা ৩ হাজার ৩০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। তাতে এক কেজি মাল্টার পাইকারি দাম হয় ২২০ থেকে ২৪০ টাকা। এভাবে পাইকারিতে সবুজ আপেল ২৪০ থেকে ৩৬০ টাকা ও লাল আপেল ২০০ থেকে ২৫০, আঙুর ৩৫০ থেকে ৪০০, কমলা ২২০ থেকে ২৫০, আনার ৩৫০ থেকে ৪০০, নাশপাতি ২০০ থেকে ২২০, ড্রাগন ১২০ থেকে ১৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। ফলের বিভিন্ন মান থাকে। মান কম হলে দামও কম হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)- এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ফল আমাদের অন্যতম প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য। অথচ বাজারে কার্যকর তদারকির অভাবে আমদানিকৃত ফলের দাম লাগামছাড়া হয়ে উঠছে। আমদানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এই খাতে সিন্ডিকেটের প্রভাবও বেড়েছে। ফলে সাধারণ ক্রেতারা ন্যায্য দামে ফল কিনতে পারছেন না। এই অব্যবস্থাপনা দূর করতে বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করতে হবে এবং আমদানির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে ফলের বাজারে বৈষম্য বাড়তেই থাকবে এবং সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
প্রিন্ট করুন





Discussion about this post