আফসানা আক্তার আফসানা : বর্তমান সমাজে কিশোর গ্যাং এক ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। সম্প্রতি সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা হু হু করে বেড়ে চলেছে। কিশোরদের এমন বেপরোয়া আচরণ সমাজব্যবস্থাকে করছে কলুষিত। অতীতে কিশোর গ্যাং বলতে ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘তিন গোয়েন্দা’সহ বিভিন্ন গ্রন্থের জনপ্রিয় চরিত্র কিশোরদের কাছে পরিচিত ছিল। এসব কিশোর গ্যাং সমাজের নানা অন্যায় ও অসংগতি রুখে দিতে কিশোরদের অনুপ্রাণিত করত। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্র্যাক প্লাটুন নামক দুঃসাহসী এক তরুণ দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে। পক্ষান্তরে কিশোর গ্যাং এখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। বর্তমানে কিশোর গ্যাং শহর থেকে গ্রাম, পাড়া-মহল্লায়, অলিতেগলিতে সর্বত্র গড়ে উঠছে আশঙ্কাজনক হারে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মতে, শুধু ঢাকা শহরে কিশোর গ্যাং রয়েছে ১২৭টি এবং এসব গ্যাংয়ের (অপরাধী দল) সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৩৮২ জন।
এ পরিসংখ্যানই বলে দেয় সমগ্র দেশের চিত্র কতটা ভয়াবহ। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, মাদক চোরাচালান, অপহরণ, যৌন হয়রানি, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি থেকে শুরু করে গুম-খুনের মতো ঘৃণ্য অপরাধে কিশোরেরা জড়িয়ে যাচ্ছে প্রায়ই। বর্তমানে কিশোর গ্যাং শুধু অভিভাবকদের জন্যই আতঙ্ক নয়; বরং পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর।
কিশোর গ্যাং বলতে কী বোঝায়? কিশোর গ্যাং বলতে মূলত অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের এমন সংগঠিত দলদের বোঝায় যারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বহু ধরনের মানুষ বসবাস করে এমন শহুরে এলাকায় এই ধরনের দল গড়ে ওঠে। এ দলগুলোর নিজেদের মধ্যে একটি ক্ষমতা কাঠামো থাকে, নিজেদের নির্ধারণ করা এলাকা থাকে এবং নির্দিষ্ট ধরনের অপরাধকেন্দ্রিক লক্ষ্য থাকে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য শুরু হয় ১৯৯০ সালের দিকে। ২০২৪ সালে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ছিল ২৩৭টি। এসব গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা অন্তত দুই হাজার ৩৮২ জন। ২০২২ সালে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ছিল ১৭৩টি, সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। অর্থাৎ দুই বছরে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা বেড়েছে ৬৪টি বা ৩৭ শতাংশ। একই সময়ে এসব গ্রুপের সদস্য বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার, যা আগের সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ জার্নালে প্রকাশিত ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ছে। ছয় বছরে এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। ২০২০ সালে অপরাধে জড়িত শিশুদের ৬১ শতাংশই ছিল ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সের মধ্যে, যা ২০১৪ সালে ছিল ২৪.৭ শতাংশ।
২০২৩ সালে জার্নাল অব এমার্জিং টেকনোলজিস অ্যান্ড ইনোভেশন রিসার্চে (জেইটিআইআর) প্রকাশিত মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের ‘স্টাডি অব চিলড্রেন ক্রাইমস এট আরবান এরিয়াজ ইন বাংলাদেশ’ গবেষণায় বলা হয়, অপরাধে শিশুদের সম্পৃক্ততা বর্তমান সময়ে সত্যিই উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। তাদের মুষ্ঠিমেয়দের কর্মকাণ্ডে সমাজ আক্রান্ত হচ্ছে, যা অদূর ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে শিশুদের ৭৫ শতাংশই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। মাদকাসক্তি, মাদক ব্যবসা, চুরি, ডাকাতি, আগ্নেয়াস্ত্র বহন, ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে এসব শিশু। অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হলো দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাব। অধিকাংশ শিশু ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সে অপরাধে যুক্ত হয়। যেসব অপরাধের জন্য শাস্তি অনিবার্য, বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তাদের উন্নয়নকেন্দ্রে পাঠানো ছাড়া বড় কোনো শাস্তি দেওয়া হয় না। কিশোর অপরাধের ধরন ও পর্যায় বিবেবেচনায় একটি দেশের আইনের শাসনের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়।
গোয়েন্দা সংস্থার মতে, মাদক ব্যবসার মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে অধিকাংশ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে তাদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। আধিপত্য নিয়ন্ত্রণে কিশোর গ্যাংগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বে প্রায়ই ঘটছে গোলাগুলোর ঘটনা, বাড়ছে হত্যাকাণ্ড। তবে এসব অপরাধের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জমি দখল, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি বিভিন্ন থানায় মাদক ব্যবসায়ী ও চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের পৃথক তালিকায় এমন অনেক কিশোর অপরাধীর নাম উঠে এসেছে।
এশিয়ান জার্নাল অব সোশিওলজিক্যাল রিসার্চে ২০২১ সালে প্রকাশিত ‘প্রসেস অব ক্রিমিনালাইজিং স্ট্রিট চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ; এন এমপায়রিকাল স্টাডি ইন দ্য সিটি অব ঢাকা’ গবেষণায় বলা হয়, অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের ৯০.৫ শতাংশই মাদক ব্যবসা এবং ৩০.১ শতাংশ হত্যার সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া ছিনতাইয়ে জড়িত ৬৬ শতাংশ ও চুরির সঙ্গে জড়িত শতভাগ শিশু।
কিশোর গ্যাংয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জড়িয়ে পড়ার কারণ কী? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিশোরদের মধ্যে গ্যাং সংস্কৃতি দেখা যায়। উন্নত দেশগুলোয় এর ওপর অনেকে গবেষণাও হয়েছে। এর ভিত্তিতে কিশোর অপরাধের কারণ হিসেবে নানা ধরনের মনোসামাজিক ও আর্থসামাজিক কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সামাজিক অব্যবস্থাপনা, অনিরাপদ এলাকায় বসবাস, বিদ্যালয়ে ব্যর্থতা, বিচ্যুত সঙ্গীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, নেতৃত্বের তীব্র আকাক্সক্ষা, পারিবারিক দায়িত্বহীনতা, পারিবারিক বঞ্চনা, পরিবারের সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, মাদক প্রভৃতি সামাজিককারণ এবং গুরুতর মানসিক আঘাত কিংবা ট্রমা, বিষণ্নতা, মনোযোগহীনতা, কম আত্মমর্যাদা, দ্রোহী মনোভাব এবং নৈতিক অবক্ষয়সহ বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক কারণের সঙ্গে কিশোর অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রবণতার কিংবা গ্যাং অন্তর্ভুক্তির তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক এসব গবেষণায় উঠে এসেছে।
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে করণীয়: কিশোরদের গ্যাং অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের করার জন্য কিছু সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আমাদের প্রথাগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে পরিবারভিত্তিক, বিদ্যালয়কেন্দ্রিক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক উদ্যোগের কথা বলা হলেও কর্মসূচি নির্দিষ্ট না থাকার কারণে যথাযথ সচেতনতা তৈরি করা।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রিন্ট করুন




Discussion about this post