আসাদুজ্জামান রাসেল, রাজশাহী : একসময় কৃষকের আস্থা ও আশা-ভরসার বড় পাটাতন ছিল বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। বর্তমানে ব্যাংকটি চরম আর্থিক সংকট, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কবলে পড়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। ব্যাংকটির হাজার হাজার কৃষিনির্ভর গ্রাহক ঋণ না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। বাংলাশে কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এই ব্যাংকের একীভূতকরণেরও একটি উদ্যোগ বিগত সরকার নিয়েছিল। তবে সেই উদ্যোগটি নিয়েও এখন আর কোনো কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে ব্যাংকটির মাঠপর্যায়ের কোনো কোনো কর্মকর্তা ঘুস ছাড়া ঋণ বিতরণে আগ্রহ খোচ্ছেন না বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৩ সালের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেনে ব্যাংকটির একাধিক শাখায় ঋণ নিতে কৃষকরে ঘুস দিতে হয় এমন তথ্য উঠে আসে। তাতে বলা হয়, প্রতিটি ঋণের বিপরীতে ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ‘কমিশন’ দিতে হতো কর্মকর্তাদের। এই অনৈতিক প্রক্রিয়া এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি বলে একাধিক কৃষক অভিযোগ করেছেন।
রাজশাহীর দুর্গাপুরের ভুক্তভোগী এক কৃষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, “ঋণের জন্য আবেদন করেছিলাম ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। আমাকে বলা হয়েছিল, ফাইল এগোতে হলে ‘খরচাপাতি’ লাগবে। আমি টাকা দিতে না পারায় ঋণটি পাইনি।”
২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত রাকাবের আর্কি প্রতিবেদন, সরকারি অডিট রিপোর্ট এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করেও ব্যাংকটি গুরুতর আর্থিক ও ব্যবস্থাপনা সংকটের কথা জানা যায়। ঋণখেলাপি বৃদ্ধি, মূলধন ঘাটতি, দুর্নীতি ও তহবিল সংকটের কারণে ব্যাংকটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই সংকট মোকাবিলায় দ্রুত, স্বচ্ছ এবং কার্যকর পক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নয়তো উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের আর্থিক সহায়তা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিভিন্ন সরকারি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২০ সাল থেকে রাকাবের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে ৯০০ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ ছিল, যা ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে আনুমানিক ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। অনাদায়ী ঋণের হার শতকরা হিসেবে বেড়ে ১৮ শতাংশ থেকে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় সংকট।
সঙ্গে মূলধন ঘাটতির অবস্থা ক্রমাগত বাড়ছে, ২০২০ সালে যা ছিল ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, তা ২০২৪ সালে ২ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা এবং ২০২৫ সালে আনুমানিক ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। অর্থাৎ ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে, যা ঋণ বিতরণ ও আমানত ফেরতের ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি করেছে।
অডিট রিপোর্ট থেকে প্রমাণিত দুর্নীতি ও আর্কি অনিয়ম: ২০২২ সালের সরকারি অডিট রিপোর্টে রাকাবের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও ঋণখেলাপির ব্যাপকতা স্পষ্ট হয়েছে। অডিট রিপোর্টে বলা হয়, ‘রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক বিবরণী এবং কার্যক্রমের অবস্থা উদ্বেগজনক। ব্যাংকের ঋণখেলাপির হার ২৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যা ব্যাংকের স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি। মূলধন ঘাটতি প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, ঋণ পরিশোধ নিশ্চিতকরণ এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য কঠোর পক্ষেপ নিতে হবে।’
ব্যাংকের বর্তমান অবস্থান ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বিবেচনা করে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাকাবের ঋণ বিতরণ আমানত থেকে বেশি হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি লঙ্ঘন, যা দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকের অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। ঋণখেলাপির কারণে ব্যাংকের তহবিল সংকট গম্ভীর রূপ নিয়েছে; ব্যাংক বড় বড় আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
রাকাবের পরিচালনা কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছেন যে, ব্যাংক একটি তারল্য সংকটে রয়েছে। ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিকবার সরকারি প্তর ও মন্ত্রণালয়কে আমানত জমা দিতে অনুরোধ করেছেন, সেক্ষেত্রে তারা আশানুরূপ ফল পাননি।
তবে দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে কার্যকর পক্ষেপ না নিলে ব্যাংকের পুনরুদ্ধার অনিশ্চিত বলেই ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। কৃষক ও গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য রাকাবের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
বাংলাশে ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেনে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত রাকাবের বিতরণকৃত মোট ঋণের মধ্যে ২১ দশমিক ৩৭ শতাংশ বা ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা অনাদায়ী। মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংক খাতের জন্যই নয়, কৃষি অর্থনীতির জন্যও এক অশনিসংকেত। ২০১৯ সালে ব্যাংকটি ৫ হাজার ২৭৬ কোটি টাকার আমানতের বিপরীতে ৫ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছিল, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ৮৫ শতাংশ ঋণ-আমানত অনুপাত অতিক্রম করে।
অন্যদিকে কাগজে মুনাফা বাস্তবে লোকসান দেখানো পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাকাব কর্তৃপক্ষ ৮২ শমিক ৪৫ কোটি টাকা মুনাফার ঘোষণা দিলেও বাংলাদেশ অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানটি ২৮ কোটি টাকার লোকসানে ছিল। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, এই আর্থিক অসংগতির পেছনে কারা দায়ী?
এদিকে ব্যাংকটির একীভূতকরণ প্রক্রিয়াও থমকে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রাকাবকে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করতে চেয়েছিল।
অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, একীভূতকরণ তখনই কার্যকর, যখন ভেতরের দুর্নীতি ও কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করে তার সমাধান করা হয়। রাকাবের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। বরং সমস্যা চাপা দিতে গিয়ে অন্য ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতাও ঝুঁকিতে পড়বে।
কৃষকের উদ্বেগ ‘আমরা তাহলে যাব কোথায়?’ উত্তরের কৃষকরে জন্য রাকাব একমাত্র কৃষি-আশ্রিত ব্যাংক। অনেক কৃষক এখন প্রশ্ন করছেন, যি এটি বিলীন হয় বা একীভূত হয়, তবে তাদের কৃষিঋণের ভবিষ্যৎ কী হবে? ঋণের প্রক্রিয়া কি আরও জটিল হবে? প্রকৃত কৃষকরা কি সুবিধা পাবে, নাকি দালালরাই আবার লাভবান হবে?
রাকাবের সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও একীভূতকরণের বিরোধিতা করছেন। বগুড়া শাখায় সম্প্রতি মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ‘রাকাব শুধু একটি ব্যাংক নয়, এটি একটি অঞ্চলভিত্তিক কৃষি উন্নয়ন কাঠামো। এটি ধ্বংস হলে কৃষকের উন্নয়নের সম্ভাবনাও শেষ হবে।’ তারা বলছেন, সরকারের উচিত একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে রাকাবের দুর্নীতি, অনিয়ম ও কাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান নিশ্চিত করা।
এসব বিষয়ে রাকাব চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ আলী বললেন, একীভূত করার বিষয়ে তার যুক্তিযুক্ত অসম্মতি রয়েছে এবং দুর্নীতির বিষয়ে তিনি বলেন, রাকাবে পরিচালকসহ অন্য যারা আছেন, এ বিষয়ে কাজ করছেন, তারা সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন এবং এ বিষয়ে ব্যবস্থাও নিতে পারবেন।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডি ওয়াহিদা বেগম জানান, একীভূতকরণ বিষয়টি সরকারের, তবে উত্তরাঞ্চল যেহেতু কৃষিনির্ভরশীল অর্থনীতিতে চলে, কলকারখানা নেই বললেই হয়, সুতরাং এই বিশেষায়িত ব্যাংকটি উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি বিষয়ে তিনি জানান, এ বিষয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে যি লিখিত অভিযোগ আসে, তাহলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।

Discussion about this post