ইমতিয়াজ আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ : দখল-দূষণে প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জের নদনদীগুলো অস্তিত্ব হারাচ্ছে। বিশেষ করে জেলার প্রধান নদী শীতলক্ষ্যার পানি চরম দূষিত হয়ে পড়েছে এবং অস্তিত্ব সংকটে। বাণিজ্যনগরী নারায়ণগঞ্জকে প্রায় ঘিরে রেখেছে পাঁচটি নদী ও দুটি নদ। শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, মেঘনা, ধলেশ্বরী ও মারিখালী নদী এবং ব্রহ্মপুত্র ও বালু নদ। বিগত ১৫-২০ বছরের মধ্যে নদীগুলো নানা অবহেলায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এক সময়ে শীতলক্ষ্যার পানি পান করত মানুষ। এ নদীতে মাছ ধরে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করত। তবে সময়ের পরিক্রমায় সবকিছুই পাল্টে গেছে। পানি পান তো দূরের কথা, এখন শীতলক্ষ্যায় মাছ পাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। দূষণের কবলে জৌলুস হারাচ্ছে ১০৮ কিলোমিটারের শীতলক্ষ্যার বুক। নদীতীরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কলকারখানার কঠিন-তরল বর্জ্য ড্রেন ও পাইপের মাধ্যমে নদীতে ফেলা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ, পরিবেশ বিজ্ঞানী এবং নদীবিশারদরা বলছেন, এতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ওই অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি।
নারায়ণগঞ্জের মূল শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। এর পূর্বে মেঘনা ও হাঁড়িধোয়া, পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা ও দক্ষিণ-পশ্চিমে ধলেশ্বরী নদী, রূপগঞ্জের পশ্চিমে বালু নদ মিশে গেছে শীতলক্ষ্যার সঙ্গে। পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদও জেলার পশ্চিম দিক দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদরে ধলেশ্বরী নদীতে মিলিত হয়েছে। সোনারগাঁওয়ের মারিখালী ৮ কিলোমিটার নদী মেঘনা থেকে শুরু হয়ে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে শেষ হয়েছে।
সরজমিনে দেখা যায়, শীতে শীতলক্ষ্যার পানি কালো রং আরও প্রগাঢ় হয়ে আলকাতরার রূপ নিয়েছে। তার সঙ্গে বেড়েছে উৎকট গন্ধও। তবে বর্ষায় নদীর পানি কিছুটা পরিষ্কার হলেও শুকনো মৌসুমে এ নদীর পানি একেবারেই ব্যবহার যোগ্য থাকে না। নারায়ণগঞ্জ সেন্ট্রাল খেয়াঘাট সংলগ্ন ওয়াকওয়ের নিচে নির্মাণকৃত বিশালাকৃতির ড্রেন দিয়ে রং ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির ধারা সরাসরি শীতলক্ষ্যায় পড়ছে। সেন্ট্রাল খেয়াঘাট থেকে টানবাজারের দিকে যেতে নজরে আসে বেশ কয়েকটি ড্রেন। একই সঙ্গে পলিথিন ও গৃহস্থালির বর্জ্যও পড়ছে।
নদী দখলের প্রতিযোগিতায় এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলায় থাকা ৬৭ খালের বেশির ভাগই। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, নদীর অস্তিত্ব সংকটের জন্য দায়ী দখলদারের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কখনও কখনও চালিয়েছে উচ্ছেদ অভিযান। কিন্তু রাতের আঁধারে, কখনও দিনদুপুরে আবার দখল হয়ে যাচ্ছে উচ্ছেদকৃত স্থানগুলো। আর এভাবে একের পর এক দখলদারদের পেটে চলে যাচ্ছে নদ-নদীগুলো। শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরে গড়ে ওঠা অন্তত ৭০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সীমানায় কৃত্রিমভাবে নদী ভরাট ও দখলের অভিযোগ রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. রায়হান কবীর বলেন, নদী দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করা হবে। সঙ্গে কলকারখানাকেও শতভাগ ইটিপি ব্যবহারে নজরদারির আওতায় আনার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। নদীর দূষণ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের ৪৮ নদী সমীক্ষা প্রকল্পের আংশিক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে শীতলক্ষ্যার বেহাল চিত্র। এতে বলা হয়েছে, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রয়েছে ২৮২টি দূষণের উৎস। নদীর গতিপথেও আছে ৪৯০টি দূষণের স্থান। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, ঢাকা ওয়াসা এবং পৌরসভাও চিহ্নিত করেছে ৯১টি দূষণ-উৎস। নদীতীরের ছোট-বড় ২২২টি শিল্পকারখানা ও বসতবাড়ির পাশাপাশি হাসপাতাল, আড়ত, ডায়িং ফ্যাক্টরি, পোলট্রি খামার এবং ইটভাটার কঠিন-তরল বর্জ্য ড্রেন ও পাইপের মাধ্যমে নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। বারবার অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ ও জরিমানা আদায় করেও বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
পরিবেশে অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ের ২ হাজারেরও বেশি শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। আর এর মধ্যে তরল বর্জ্যে নির্গমনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে শিল্প-কারখানাগুলোয় বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) রয়েছে ৪০৭টি প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে ব্যবহার করছে ৩০১টি প্রতিষ্ঠান। একদিকে দূষণ ও অন্যদিকে দখলের কবলে প্রতিনিয়ত তার জৌলুস হারাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের প্রাণসলিল শীতলক্ষ্যা। নদীর দুইপাশ ডকইয়ার্ড, গোডাউন, কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনার দখলে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।
কলকারখানার কেমিকেলযুক্ত বিষাক্ত বর্জ্যে পরিবেশ দূষণ নতুন কিছু নয়। বছরের পর বছর ধরে এটা হয়ে আসছে। অথচ এই দূষণরোধে পরিবেশ আইনে শিল্প-কারখানায় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। নারায়ণগঞ্জের ১২০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানেই ইটিপি নেই। এসব শিল্পকলখানার রং, বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি পাশের খাল-বিল, নালা ও ড্রেনের মাধ্যমে মিশে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়ছে। এতে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। বিবর্ণ আকারের সেই পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গার পানি। আবার আবাসিক এলাকার ওপর দিয়ে ড্রেন ও খালের মাধ্যমে প্রবাহিত বিষাক্ত পানির দুর্গন্ধে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তবে নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, ইটিপিবিহীন কারখানার বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত এক বছরের তারা ২০টি কারখানার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে এবং ১৮টি কারখানার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু তারপরও ইটিপির আওতায় আসছে না কারখানাগুলো। যার কারণে দূষণের কবল থেকে নিস্তার মিলছে না নারায়ণগঞ্জবাসীর।
অভিযোগ রয়েছে নারায়ণগঞ্জে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা খরচ বাঁচানোর জন্য রাতের আঁধারে তাদের শিল্প-কারখানার বর্জ্য কোনো শোধন না করেই সরাসরি খাল-বিল বা নালায় ছেড়ে দিচ্ছে।
পরিবেশ আন্দোলন ও নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিক জানান, শীতলক্ষ্যা নারায়ণগঞ্জের প্রাণ। কিন্তু বর্জ্য ও দখলের শিকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যা। নদী রক্ষার আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে শীতলক্ষ্যা এখন অস্তিত্ব সংকটে। নদীর দুই পার দখল করে নদীকে লম্বা খাল বানিয়ে দিচ্ছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সূত্র মতে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে পাঁচ শতাধিক নদী হারিয়ে গেছে, যেখানে সারাদেশে নদীপথ ছিল ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে সাত হাজারে। নারায়ণগঞ্জে ২০ বছর ধরে নদীর পার দখল করে রেখেছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। দখলের এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই ব্যক্তি উদ্যোগও। স্বাভাবিকভাবে নদী থেকে সৃষ্টি হয় খাল।
বিআইডব্লিউটিএর সূত্র মতে, জেলার প্রধান এই নদীতে ৪৬৮টি অবৈধ স্থাপনা নদীকেই গিলে খাচ্ছে। এ ছাড়া অন্তত ২০টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সামনের সীমানা পিলার নিয়েও রয়েছে আপত্তি। শীতলক্ষ্যা নদীতে পাঁচ সহস্রাধিক সীমানা নির্ধারণী পিলার স্থাপন করা হলেও এর মধ্যে দুই সহস্রাধিক পিলার নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন বলেন, শীতলক্ষ্যা বাঁচাতে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্নভাবে সামাজিক আন্দোলন করে যাচ্ছি। অথচ প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে আজও শীতলক্ষ্যার দূষণ বন্ধ হচ্ছে না। গত বছর যদি প্রশাসন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিত, তাহলে এবার আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। শীতলক্ষ্যার পানি এখন বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। শিল্পবর্জ্য মিশ্রিত বিষাক্ত পানির কারণে এখন দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে কৃষি অর্থনীতি।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এএইচএম রাসেদ বলেন, শীতলক্ষ্যা দূষণের বিভিন্ন উৎসস্থল চিহ্নিত করতে আমরা কাজ শুরু করেছি। সীমিত জনবল দিয়ে আমাদের কাজ করতে গিয়ে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। আমরা আশা করছি, খুব দ্রুত দূষণ বন্ধ করতে পারব।
প্রিন্ট করুন



Discussion about this post