রোদেলা রহমান : বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বড় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বিস্ময়কর তথ্য হলো, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলনায়ও কম বেতন পাচ্ছেন। উচ্চশিক্ষিত, গবেষণায় নিয়োজিত এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলা শিক্ষকরা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সমান বা তার চেয়েও কম বেতন হাতে পান, তখন বিষয়টি শুধু বৈষম্য নয়, বরং এক ধরনের অবমাননাও বটে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের ‘বি’ এবং ‘সি’ গ্রেডের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মাসিক বেতন মাত্র ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। উদাহরণ হিসেবে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং উত্তরা ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে, যেখানে একজন লেকচারার মাসে মাত্র ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে চাকরি শুরু করেন।
অন্যদিকে একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গ্রেড-১৩ অনুযায়ী মাসিক ১৪ হাজার ৫৩৯ টাকা মূল বেতন পান। বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা এবং বার্ষিক ইনক্রিমেন্টসহ তাদের মোট আয় এবং চাকরির নিরাপত্তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলনায় অনেক বেশি।
এই বৈষম্য আরও প্রকট হয় যখন দেখা যায়, দেশের প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন- নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষকদের জন্য অনেক বেশি সম্মানজনক বেতন কাঠামো অনুসরণ করে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন লেকচারারের মাসিক বেতন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে, যা প্রমাণ করে যে পর্যাপ্ত ফান্ডিং থাকলে শিক্ষকদের ন্যায্য বেতন দেয়া সম্ভব। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই এই মান অনুসরণ করে না।
এই বেতন বৈষম্যের মূল কারণ হলো দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ নেই। ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন বোর্ড অব ট্রাস্টিজকে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে, যার ফলে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো বেতন ও সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষাকে একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে দেখে, যেখানে শিক্ষকদের বেতন কমানো হয় মুনাফা বাড়ানোর জন্য। অবকাঠামো নির্মাণ এবং প্রশাসনিক খাতে অতিরিক্ত ব্যয়ের অজুহাতে শিক্ষকদের প্রাপ্য সম্মান ও বেতন থেকে বঞ্চিত করা হয়।
বেতন কাঠামো নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, আমরা বেতন হিসেবে যে অর্থ পাই তা দিয়ে নিজের খাওয়া-পরার খরচই জোগান হয় না। আমরা বাসাভাড়া নিয়ে থাকতে পারি না। মেসে থেকেই জীবন চালাই। ঠিকমতো সংসারে টাকা দিতে পারি না। এসব কারণে সব সময় এক ধরনের মানসিক চাপে থাকতে হয়। এতে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে মারাত্মকভাবে ব্যাঘাত ঘটে।
এই বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে এবং আমরা এ নিয়ে কাজ করছি। উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের ন্যায্য বেতন ও সম্মানজনক কর্মপরিবেশ খুবই জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেখছি, অনেক মেধাবী শিক্ষক বিদেশে চলে যাচ্ছেন কেবলমাত্র পর্যাপ্ত বেতন ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি ন্যূনতম বেতন কাঠামো নির্ধারণের জন্য বারবার তাগিদ দিচ্ছি। শিক্ষকদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং গবেষণার ওপর ভিত্তি করে একটি স্ট্যান্ডার্ড বেতন স্কেল থাকা উচিত। আমরা আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। যদি তারা স্বেচ্ছায় এই উদ্যোগ না নেয়, তবে আমরা সরকারিভাবে নীতিমালা প্রণয়নের কথা ভাবছি।’
শিক্ষাবিদরা বলেন, ‘যে শিক্ষক উচ্চশিক্ষা দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তুলছেন, তার বেতন যদি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকের চেয়েও কম হয়, তাহলে এটিকে উচ্চশিক্ষাকে অবমূল্যায়ন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। আর্থিক নিরাপত্তা না দিলে শিক্ষকরা গবেষণায় মনোযোগী হতে পারেন না, যার ফলে শিক্ষার মান কমে যায়।
এই বেতন বৈষম্যের ফলে উচ্চশিক্ষা খাতে গবেষণার আগ্রহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। যখন একজন শিক্ষককে তার মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হয়, তখন তার পক্ষে গবেষণার মতো সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল কাজে মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাত আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ও উদ্ভাবনে পিছিয়ে পড়ছে।
এই বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে সাধারণত স্নাতকোত্তর, এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী হতে হয়, যেখানে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের যোগ্যতা তুলনামূলকভাবে কম। শিক্ষাগত যোগ্যতা, গবেষণায় অবদান এবং ভবিষ্যৎ প্রজš§কে নেতৃত্ব দেয়ার গুরু দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আর্থিক দিক থেকে অবহেলিত।
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার রুবাইয়া সুলতানা বলেন, ‘আমি মাস্টার্সের পর এমফিল করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি প্রায় দুই বছর হলো। মাসে হাতে পাই ২৪ হাজার টাকা। সরকারি চাকরি বলে তার পেনশনও নিশ্চিত। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে কোনো নিরাপত্তা নেই। চাকরিটা টিকবে কিনা সেই অনিশ্চয়তা সবসময় মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়।’
একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন আরেক শিক্ষক, যিনি একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, ‘এমবিএ শেষ করে আমি অনেক আশা নিয়ে শিক্ষকতায় এসেছিলাম। মাসে ২৫ হাজার টাকা বেতন পাই। অথচ আমার এক আত্মীয় প্রাইমারি স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করে ৩২ হাজার টাকা পাচ্ছে। বিষয়টি লজ্জাজনক ও নিরুৎসাহজনক।’
এদিকে চাকরির অনিশ্চয়তাও এই খাতে বড় সমস্যা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অভিযোগ করেছেন, প্রশাসনের সঙ্গে সামান্য মতভেদ হলেই তাদের চাকরি চলে যেতে পারে। একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, ইনক্রিমেন্ট অনিয়মিত, বোনাস নেই, চাকরি কত দিন টিকবে তার নিশ্চয়তা নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্টেট ইউনিভার্সিটির এক সিনিয়র লেকচারার বলেন, ‘আমরা সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ক্লাস নিই, খাতা পরীক্ষা করি, রিসার্চে গাইড করি। অথচ আমাদের বেতন সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকের চেয়েও কম। আবার চাকরি হারানোর ভয় সবসময় তাড়া করে। ফলে অনেকেই বিদেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন।’
অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার বলেন, ‘শিক্ষকদের বেতন কাঠামো প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন। তবে আমরা চেষ্টা করছি সরকারি বেতনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে। কিন্তু অবকাঠামো নির্মাণ, ভাড়া ও প্রশাসনিক খরচের কারণে অনেক সময় দ্রুত সমন্বয় করা সম্ভব হয় না।’
বেতনের বৈষম্য, চাকরির অনিশ্চয়তা এবং পর্যাপ্ত গবেষণা সুবিধার অভাবে অনেক শিক্ষকই এখন বিদেশমুখী হয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ইউরোপ, কানাডা, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ মিললেই তারা বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছেন। সেখানে তুলনামূলক কম যোগ্যতা নিয়েও কয়েক গুণ বেশি বেতন, গবেষণার জন্য আলাদা তহবিল, আবাসন ও অন্যান্য সুবিধা মেলে। ফলে দেশে থেকে অল্প বেতনে অনিশ্চিত জীবনের চেয়ে বিদেশে স্থায়ী হওয়ার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে।
কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের এক সাবেক শিক্ষক জানান, ‘আমি কানাডায় পোস্টডক্টরাল করতে গিয়েছিলাম। সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে স্থায়ী চাকরির প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশের তুলনায় ১০ গুণ বেতন। দেশে ফিরে এসে ২৫ হাজার টাকায় জীবন চালানো সম্ভব নয়।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন সময় এসেছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ন্যূনতম বেতন কাঠামো নির্ধারণ করার। সরকার চাইলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করে এটি বাস্তবায়ন করতে পারে। প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকরা সব মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা পাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে অন্তত দ্বিগুণ, অর্থাৎ ৬০ হাজার টাকা বেতন থেকে শুরু করা উচিত। নইলে উচ্চশিক্ষা খাত ধসে পড়বে।
বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা উদ্বেগজনক। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা যেখানে সরকারি সুবিধা ভোগ করছেন, সেখানে উচ্চশিক্ষার শিক্ষকরা বঞ্চিত। শিক্ষকদের জন্য ন্যায্য বেতন ও চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। কারণ শিক্ষকই শিক্ষার মূল ভিত্তি, আর তাদের অবমূল্যায়ন মানে দেশের উচ্চশিক্ষা ও ভবিষ্যতকে বিপন্ন করা।

Discussion about this post