ড. শাহাবুদ্দিন আহমেদ : পৃথিবীর যে কোনো দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে ব্যাংকিং খাতের গুরুত্ব নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই খাতকে স্থিতিশীল, দক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ রাখার কেন্দ্রবিন্দু হলো দক্ষ এবং নৈতিকতা সম্পন্ন মানবসম্পদ।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১২টি শিডিউল্ড ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করত— যার প্রায় সবগুলোরই হেডকোয়ার্টার ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। যুদ্ধকালীন এবং তৎপরবর্তী স্বাধীনতা উত্তরকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (স্বাধীন বাংলাদেশের) ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রকারান্তে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যায়, জামানত ফ্রিজ করে দেয়া হয়। স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭২ সালে এক সরকারি আদেশে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে। সোনালী, জনতা, অগ্রণী এবং রূপালী ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধিভুক্ত হয়। তৎপরবর্তী ১৯৮২ সালে আরব বাংলাদেশ ব্যাংক (এবি ব্যাংক) নামে প্রথম বেসরকারি ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করে।
স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয়করণ থেকে বেসরকারীকরণ ও নানামুখী সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ সম্মিলিত চিত্র অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ৬২টি শরিয়াহভিত্তিক ও প্রচলিত পদ্ধতির নির্ধারিত (ঝপযবফঁষবফ) ব্যাংক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক, ৪৩টি প্রাইভেট কমার্শিয়াল ব্যাংক (যার মধ্যে ১০টি ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক) এবং একটি ‘ডিজিটাল কমার্শিয়াল ব্যাংক’ অনুমোদন পর্যায়ে রয়েছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সফলতার পাশাপাশি হতাশার গল্পটাও অনেক ভারি যার মূলে রয়েছে দক্ষতার অভাব, শাসনব্যবস্থা ও ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি, সরকারের অনৈতিক আধিপত্যবাদ এবং দক্ষ এবং নৈতিকতা সম্পন্ন জনগণের অভাব।
ব্যাংকিংয়ের ‘স্বাস্থ্য’ বিচার করতে একটি মুখ্য সূচক হলো ‘খেলাপি ঋণ’ বা নন-পারফর্মিং লোন (ঘচখ)-এর হার। এই সূচকে আন্তর্জাতিক তুলনায় বাংলাদেশের চিত্র বেশ উদ্বেগজনক। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের মোট খেলাপি ঋণের অনুপাত দাঁড়ায় আনুমানিক ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ, যা এক ত্রৈমাসিক আগের তুলনায় ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি- ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। সেই তুলনায়, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের ব্যাংকগুলোর স্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত। আরবিআই ভিত্তিক সরকারি পরিসংখ্যান বলছে ভারতে ২০২১ সালের খেলাপি ঋণ ৯ দশমিক ১১ শতাংশ থেকে ধারাবাহিক সংস্কার ও রেগুলেটরি পদক্ষেপে ২০২৫ সালের মার্চে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশে -এ নেমে এসেছে। উন্নত অর্থনীতিগুলোতে এই চিত্র আরও ভালো। ট্রেডিং ইকোনমিক্সের তথ্য মতে যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩ সালে ব্যাংকের এনপিএ বা খেলাপি ঋনের অনুপাত ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৮৫ শতাংশ, আর ইউরোপিয়ান ব্যাংকিং অথোরিটির তথ্যমতে ইউরোজোনে ২০২৪ জুড়ে করপোরেট ঋণে গড় খেলাপি ঋণ ছিল ৩ থেকে ৩ দশমিক ৭ শতাংশের মধ্যে। বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের খেলাপি ঋণের এই ব্যবধান ‘খারাপ গ্রাহক’ নয়, বরং ঝুঁকিনির্ভর ঋণমূল্যায়ন, পুনরুদ্ধার কাঠামো, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা এবং দক্ষ জনবলের সমন্বিত ফল।
ব্যাংক পরিচালনার কারিগর-ব্যাংকার, রিস্ক অ্যানালিস্ট, অডিটর, কমপ্লায়েন্স অফিসার, আইটি-সিকিউরিটি টিমের বহুলাংশে নির্ভর করে ব্যাংকিং খাতের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা। বাংলাদেশ ব্যাংকের খাতভিত্তিক কর্মসংস্থানের তথ্যবিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২৩ শেষে ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত জনবল প্রায় ২ দশমিক ০৪ লাখ, যা ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ২৫ হাজার বেশি। তবে পুরুষ-নারী অংশগ্রহণে বেশ পার্থক্য বিদ্যমান, যেখানে পুরুষ প্রায় ৮৪ শতাংশ। তবে ২০২৪ সালের শেষে নারী কর্মীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ৬৪৯ জনে। যদিও ঊর্ধ্বপদে তাদের অংশ এখনও ১০ শতাংশেও কম।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে বড় কেলেঙ্কারিরগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেস (২০১০-১২ সালে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি), ২০০৯-১৩ সাল বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুর জোগসাজশে প্রায় ৪ দশমিক ৫ হাজার কোটি টাকার ইঅঝওঈ ব্যাংক কেলেঙ্কারি, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা রিজার্ভ চুরি, ২০১২ সালে যমুনা, জনতা, প্রাইম ও শাহজালাল ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ ব্যাংকের গ্রুপের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ কেলেঙ্কারি, ২০১০ সাল পরবর্তী ইডেন গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, অ্যাননটেক্স এবং থার্ম্যাক্স, জনতা ব্যাংক থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারি এবং এনআরবিসি এবং ফারমার্স ব্যাংকের কয়েক শত কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারি।
স্বৈরাচার হাসিনার ফ্যাসিবাদ সরকার দারা দুর্বল অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক প্রভাব ও নৈতিক অবক্ষয় মিলেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা মোটামুটি ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই ‘ম্যান-মেড’ মানবসৃষ্ট ঝুঁকির সবচেয়ে নাটকীয় রূপ হলো ২০১৬ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক সাইবার-হেইস্ট-ঝডওঋঞ নির্দেশনা জাল করে প্রায় ১০১ মিলিয়ন ডলার বেরিয়ে যায়, যার ৮১ মিলিয়ন ফিলিপাইনে ট্রেস করা হয়। অনেকে ঘটনাটিকে সাইবার-ডিফেন্সে প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের অপ্রতুলতা হিসাবে দেখানো চেষ্টা হলেও মূলত এর পেছনে সরাসরি জড়িত ছিল শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যরা এবং স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তবে অধুনা বিশ্বে সাইবার ঝুঁকি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লগ মনিটরিং, রেড-টিম ড্রিল, ‘থ্রি-লাইন্স অফ ডিফেন্স’ বাস্তবায়নে দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই।
এতকিছুর পরেও, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিপুল অগ্রগতি দেখিয়েছে। বিশেষ করে, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) এখন দৈনন্দিন লেনদেনের নেটওয়ার্ক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের তথ্য মতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধিত এমএফএস অ্যাকাউন্ট ছিল প্রায় ২৩৭ মিলিয়ন; এর প্রায় ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ ‘অ্যাকটিভ’ (ব্যবহূত) অ্যাকাউন্ট এবং মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ছিল ১৫ দশমিক ৪ লাখ। এমন সম্প্রসারণ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উল্লেখযোগ্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস বাংলাদেশের তথ্য মতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ডিজিটাল পেমেন্টের গড় দৈনিক লেনদেন প্রায় ৪,০১৮ কোটি টাকা। এই ‘ডিজিটাল ক্যাশফ্লো’ এর নিরাপত্তা, প্রতারণা-প্রতিরোধ, গ্রাহক ডেটা সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে দক্ষ মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই।
এবারে আরও এক ধাপ এগিয়ে আসি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি (এআই), বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথায়। উন্নত অর্থনীতিতে ইতোমধ্যে এআই-মডেল ব্যবহার হচ্ছে ঋণ-স্কোরিং, ফ্রড-ডিটেকশন, অ্যানোমালি মনিটরিং, গ্রাহক-অনবোর্ডিং (ব-কণঈ), এমনকি চ্যাটবটুভিত্তিক সার্ভিসে। বাংলাদেশেও ব্যাংকের কন্ট্যাক্টুসেন্টার, কার্ড-ফ্রড মনিটরিং, কালেকশন-প্রায়রিটাইজেশন এসব কাজ এআই এর সাহায্যে উন্নত করা সম্ভব। কিন্তু এআইকে ‘প্লাগ-অ্যান্ড-প্লে’ ভাবলে ভুল হবে। ডেটা-গভর্ন্যান্স, মডেল-রিস্ক ম্যানেজমেন্ট (গজগ), বায়াস-মিটিগেশন এবং সাইবার-রেজিলিয়েন্স এসবই প্রশিক্ষিত টিম ছাড়া সম্ভব নয়। মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনায় যদি ‘ডেটা ইঞ্জিনিয়ারিং + এমএল অপস + রিস্ক/কমপ্লায়েন্স’ ত্রিভুজটি না থাকে, তবে এআই অনুপাত বাড়লেও উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। বরং ‘মডেল রিস্ক’ নতুন জটিলতা তৈরি করবে।
সরকারি নীতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা এই প্রেক্ষাপটে ‘নিরপেক্ষতা’ ও ‘প্রেডিক্টেবিলিটি’ সবচেয়ে জরুরি। আন্তর্জাতিক বেবেচনায়, ইউরোপে নিয়ন্ত্রকের ধারাবাহিক সংকেত ও প্রভিশনিং বিধি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হয়েছে। ইউরোপীয় ব্যাংকিং তদারকির সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে করপোরেট ও হাউজহোল্ড ঋণে এনপিএ ২-৪ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে এবং ছোটখাটো রিস্ক আপটিক হলেও আগেভাগে প্রভিশন বাড়ানোর নির্দেশনা ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা চাপমুক্ত একটি প্রেডিক্টেবল নিয়ন্ত্রক পরিবেশ থাকলে ব্যাংকগুলোর রিস্ক কালচার শক্ত হয়, ‘ইনস্ট্রাকশন’ নয় ‘ইনস্টিটিউশন’ কাজ করে। বাংলাদেশে দেখেছি, যখনই নিয়ন্ত্রকের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়, অথবা প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের বিষয়ে ‘স্ল্যাক’ বার্তা যায়, তখন মাঠপর্যায়ে ক্রেডিট ডিসিপ্লিন দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সৃষ্টি হয় বা প্রভাব পড়ে খেলাপি ঋণ, রিস্ট্রাকচারিং বা ঋণ পুনর্গঠন, এবং ‘এভারগ্রিনিং (প্রতারণামূলক বা অনৈতিক পদ্ধতি)’। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু বড় কনগ্লোমারেটের অর্থ পাচার ও ব্যাংক সম্পৃক্ত জালিয়াতি নিয়েও জনমনে আস্থার প্রবল ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এগুলো সমাধান করতে হলে নীতি-অবিচলতা ও স্বচ্ছ তদন্তের পাশাপাশি দরকার কার্যকরী পদক্ষেপ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে দক্ষ মানবসম্পদ বলতে আমরা কি বুঝি? প্রথমত, ‘রিস্কভিত্তিক ক্রেডিট কালচার’, ডেটা নির্ভর ক্যাশ-ফ্লো অ্যানালাইসিস, স্ট্রেস-টেস্টিং, ইন্ডাস্ট্রি-বেঞ্চমার্কিং, কনসেন্ট্রেশন লিমিটবিষয়ক হাতেকলমে দক্ষতা। দ্বিতীয়ত, ‘কমপ্লায়েন্স ও কন্ডাক্ট’, অ্যান্টি মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচার প্রতিরোধ ব্যবস্থা, কম্বেটিং ফানেন্সিং অব টেররিসম বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ, স্যাংশন স্ক্রিনিং, ইনসাইডার লেনদেন প্রতিরোধ এবং ভোক্তা সুরক্ষা সম্পর্কিত আপ-টু-ডেট বা হালনাগাদ জ্ঞান। তৃতীয়ত, ‘টেক-স্কিল’, সাইবার হাইজিন, সিকিউরিটি অপস, ক্লাউড-গভর্ন্যান্স, ডেটা-প্রাইভেসি, এআই-বেসিক্স। চতুর্থত, ‘সফটুস্কিল’, নীতি-নিষ্ঠা, জবাবদিহি, ক্লায়েন্ট-সেন্ট্রিক সেবা, এবং সংকটে সিদ্ধান্ত গ্রহণের। উন্নত দেশে কেন ঋণ খেলাপি কম থাকার কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে উপরিউক্ত চার স্তম্ভে ধারাবাহিক বিনিয়োগের পাশাপাশি বার্ষিক বাধ্যতামূলক ট্রেনিংুআওয়ার, সার্টিফিকেশন (ঈঋঅ-ইনভেস্টমেন্ট অ্যানালাইসিস, পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট, ঋজগ-ফাইন্যান্সিয়াল রিস্ক (ক্রেডিট, মার্কেট, অপারেশনাল), ঈঅগঝ-মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও কমপ্লায়েন্স) এবং স্পষ্ট পারফরম্যান্স গভর্ন্যান্স।
বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টের গবেষণা বলছে দেশে এমএফএস/ইন্টারনেট-ব্যাংকিং দ্রুত বাড়ার পাশাপাশি সাইবার-ঝুঁকি, ডিজিটাল প্রতারণা, গ্রাহক ডেটা চুরির আশঙ্কাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের গবেষণা বলছে দেশে ‘অ্যাকটিভ’ অ্যাকাউন্টের হার মাত্র ৩৭ থেকে ৩৮ শতাংশের মতো। মানে নিবন্ধিত সবার হাতে ওয়ালেট থাকলেও নিয়মিত ব্যবহারকারী কম; এখানে গ্রাহক-শিক্ষা, ইউএক্স এবং আস্থা-নির্মাণে দক্ষ টিম দরকার। কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ও সময় সিরিজের তথ্য মতে নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হচ্ছে; কিন্তু জেলাভিত্তিক বৈষম্যও বেশ প্রকট। যেখানে ব্যাংক ব্রাঞ্চ কম, সেখানেই এজেন্ট ব্যাংকিং প্রচলিত ‘ব্যাংকিংয়ের বিকল্প’ হয়ে উঠছে। কিন্তু এখানে মান-নিয়ন্ত্রণ, কেওয়াইসি ও গ্রাহক-সুরক্ষা নিশ্চিত করা মানবসম্পদের জন্য বড় পরীক্ষা।
এতসবের মাঝে একটি প্রশ্ন- দেশে ঋণ খেলাপির এ পাহাড় নামবে কীভাবে? পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের উদাহরণটি এখানে শিক্ষণীয় হতে পারে। যেখানে খারাপ সম্পদ-ব্যবস্থাপনা (ওইঈ), ব্যাংক মার্জার, রি-ক্যাপিটালাইজেশন, প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (চঈঅ) এবং ক্রমাগত সুপারভিশনের ফলে ৪ বছরে এনপিএ বা খেলাপি ঋণ ৯ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৬ শতাংশে নেমেছে। বাংলাদেশে এমন নিতিমালা, দ্রুত দায়মোচন আদালতকে কার্যকর করা, পুনরুদ্ধার এজেন্ডা ‘ডেটা-ড্রিভেন’ করা এবং ব্যাংক বোর্ডে স্বাধীন পরিচালক ও রিস্ক কমিটির পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা অত্যান্ত জরুরি। এসব উদ্যোগে দক্ষ এবং নীতি নৈতিকতা সম্পন্ন মানবসম্পদ হতে পারে গেম চেঞ্জার। পুনঃতফসিল নির্ভরতাকে ‘শেষ উপায়’ রেখে, আগে থেকেই আর্লি ওয়ার্নিং সিগন্যাল, সাপ্লাই চেইন ডিফল্ট, নগদ রূপান্তর চক্র (ঈঈঈ) খারাপ হওয়া এবং ট্যাক্স ফাইলিং অস্বাভাবিকতা নিয়ে ‘প্রি-ডিফল্ট’ রিমেডিয়েশন টিম গড়া যেতে পারে।
কেবল ‘ব্যাংকার’ নয় রেগুলেটর কেও আপস্কিলড হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ফিনান্সিয়াল স্টেবিলিটি রিপোর্ট ২০২৪’ নিজেই স্বীকার করেছে উচ্চতর খেলাপির ঋণ, বড় ঋণগ্রহীতার ডিফল্ট ঝুঁকি এবং জামানতের ‘ফোর্সড সেল ভ্যালু’ কমে যাওয়ার মতো কারণগুলো সিস্টেমিক রিস্ক বাড়াচ্ছে। এর মানে, সুপারভিশনে ডেটা-অ্যানালিটিক্স, স্ট্রেস-টেস্টিং, এবং ‘থিম্যাটিক রিভিউ’ বাড়াতে হবে; একইসঙ্গে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতায় আপসহীন বার্তা দিতে হবে, যাতে মাঠে ব্যাংকগুলো ‘গভর্ন্যান্স ফার্স্ট’ নীতিতে কাজ করার প্রেরণা পায়।
এখন দেশের ব্যাংকিং খাতের সংকট নিরসন এবং উন্নয়নে বাস্তবভিত্তিক সুপারিশগুলো হতে পারে নিম্নরূপ:
১) মানবসম্পদে বাধ্যতামূলক বার্ষিক ‘স্কিল-আওয়ার’ ও সার্টিফিকেশন: রিস্ক (ঋজগ), অ্যাকাউন্টিং/অডিট (অঈঈঅ/ঈওঅ), কমপ্লায়েন্স (ঈঅগঝ), সাইবার (ঈওঝঝচ/ঈওঝগ), ডেটা/এআই (ঋড়ঁহফধঃরড়হধষ গখ), বোর্ড অ্যাপ্রুভড ট্রেনিং প্ল্যান; প্রমোশনে সার্টিফিকেশন ওয়েটেজ ইত্যাদির সংযোজন বা বাধ্যবাধকতা।
২) রিস্ক-কালচার মেট্রিক্স: শাখা/ক্রেডিট টিমের কচও তে শুধু ব্যবসা নয় ঘচখ বা নন পারফরমিং লোন ফ্লো, আর্লি ডেলিকুয়েন্সি, রোল-রেট, কালেকশনের ‘কস্ট-টু-কিউর’ ইত্যাদির প্রকাশ্য মেট্রিক চালুকরণ।
৩) ‘থ্রি-লাইন্স অফ ডিফেন্স’ শক্ত করা: ফার্স্ট লাইন (বিজনেস) এ রিস্ক-চ্যাম্পিয়ন, সেকেন্ড-লাইন (রিস্ক/কমপ্লায়েন্স) এ ডেটা-স্কোয়াড, থার্ড লাইন (ইন্টারনাল অডিট) এ টেক অডিট সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ।
৪) এআই রেডিনেস ব্লুপ্রিন্ট: ডেটা গভর্ন্যান্স, মডেল রিস্ক, বায়াস টেস্টিং, এক্সপ্লেইনেবিলিটির কার্যকর নীতিমালাসহ কার্যকর করা, যেখানে গ্রাহকের প্রাইভেসি বা গোপনীয়তাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
৫) সাইবার-রেজিলিয়েন্স: ঝডওঋঞ, কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ সব কোর সিস্টেমে রেড টিম/বুলু টিম ড্রিল; ঝঙঈ-ঝবপঁৎরঃু ঙঢ়বৎধঃরড়হং ঈবহঃবৎ ২৪/৭; ইনসিডেন্ট-রানবুক; বোর্ড-স্তরে এবং সাইবার রিস্ক রিপোর্টিং।
৬) পুনরুদ্ধার ইকোসিস্টেম: স্পেশালঅ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট (ঝঅগ) এ অ্যানালিটিক্স ড্রাইভেন স্ট্রাটেজি; ‘প্রি-ডিফল্ট’ পূর্ব হস্তক্ষেপ; এবং আইবিসি-স্টাইল দ্রুত নিষ্পত্তির কাঠামো থেকে শিক্ষা নিশ্চিতকরণ।
৭) বোর্ড-গভর্ন্যান্স: স্বাধীন পরিচালক, রিস্ক-কমিটি, রেমুনারেশন কমিটিতে দক্ষতার ম্যান্ডেট এবং পারফরম্যান্স লিঙ্কড পে-তে এনপিএ/কমপ্লায়েন্স মেট্রিক নির্ধারণ।
৮) মানব সম্পদের প্রণোদনা: ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি থেকে ডিভিশন হেড পর্যন্ত লক্ষ্যধার্য এবং অংশগ্রহণ; ফ্লেক্সিবল ওয়ার্ক/ডে কেয়ার, এবং ট্যালেন্ট-রিটেনশন পলিসির বাস্তবায়ন।
৯) রেগুলেটরি স্বাধীনতা ও প্রেডিক্টেবিলিটি : পুনঃতফসিলে ‘সানসেট ক্লজ’, বড় ঋণগ্রহীতায় স্বচ্ছ অ্যাকশন, স্ট্রেস-টেস্ট ফল প্রকাশসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো মতো আগাম প্রভিশনিং রোডম্যাপ বাস্তবায়ন।
১০) জন-আস্থা ও ভোক্তা-সুরক্ষা : গ্রাহকের ভাষায় ‘ফি ফুল ডিসক্লোজার’, ডিজিটাল ফ্রড রিকোর্সের সময়সীমা, স্মার্ট-ডিজিটাল লিটারেসি ক্যাম্পেইন বাস্তবায়ন।
পরিশেষে, বলতে হয় প্রযুক্তি এবং কেতাবি কথাবার্তা যতই বলি না কেন বাস্তবতা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত ‘মানুষ’ ই-ব্যাংকিং ব্যবস্থার গুণগতমান গুণমান নির্ধারণে প্রধান চালিকাশক্তি। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যেখানে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সৎ, নীতি নৈতিকতা সম্পন্ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ বেশি, সেখানে খেলাপি ঋণ, পুঁজির খরচ ও সাইবার দুর্ঘটনা কম, কিন্তু গ্রাহক সন্তুষ্টি বেশি। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিতে যেখানে এমএফএস নিবন্ধিত অ্যাকাউন্ট ২৩৭ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে, দৈনিক ডিজিটাল লেনদেন হাজার কোটির ঘরে, সেখানে দক্ষতা নিষ্ঠা ও জবাবদিহির ‘মানুষ’ না গড়লে এই সম্ভাবনাই উল্টো ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই আজকের প্রধান কাজ ব্যাংকের ভেতরে ‘মানবসম্পদ উন্নয়ন’-কে মূল কৌশল হিসেবে ধরা, যার মূলমন্ত্র হবে টেকনিক্যাল স্কিলের পাশাপাশি নৈতিকতার প্রশিক্ষণ, আইনের কঠোর প্রয়োগ, নীতিনির্ধারণে নিরপেক্ষতা, দেশপ্রেম, সার্টিফিকেশন, ডেটা টেক রিস্কে ক্রস স্কিলিং, মানব সম্পদে বৈচিত্র্য এবং বোর্ড স্তরের রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত গভর্ন্যান্স শক্তি বৃদ্ধিকরণ। তাহলেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত কেবল টিকে থাকবে না, বরং আস্থা, স্থিতিশীলতা ও উদ্ভাবনের শক্তিতে সামনের সারিতে ওঠে আসবে।
সহযোগী অধ্যাপক (এডজ্যাংকট) আইইউবিএটি- ঢাকা
সহকারী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব মালায়া, মালয়েশিয়া
ইমেইল: ংযধযধনঁফফরহ্তঁস.বফঁ.সু
প্রিন্ট করুন










Discussion about this post