প্রতিনিধি, বেনাপোল : দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দরে জাল মেনিফেস্টোর কাগজ ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরে সংঘবদ্ধ একটি চক্র কৌশলে একই মেনিফেস্টো একাধিকবার ব্যবহার করে ভারত থেকে বিপুল পণ্য আমদানি করছে। এ প্রক্রিয়ায় জাতীয় অর্থনীতি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বৈধ আমদানিকারকরা প্রতিযোগিতায় টিকতে হিমশিম খাচ্ছেন, তেমনি নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
আমদানি বা রপ্তানি পণ্যের নাম, পরিমাণ, ওজন, উৎস দেশ আর গন্তব্যসহ আমদানি ও রপ্তানিকারকের তথ্য সংবলিত নথিকে বলা হয় কার্গো মেনিফেস্টো। এ নথির তথ্যের ভিত্তিতেই কাস্টমস হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়। পরে শুল্ক আরোপ করা হয়। বেনাপোল স্থলবন্দরে এ মেনিফেস্টো জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানির অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, বেনাপোলে ওই নথির তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে উচ্চ শুল্কের পণ্য, বিশেষ করে কসমেটিকস ও ফেব্রিক্স অবৈধভাবে আমদানি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এ চক্রটির সঙ্গে বেনাপোল কাস্টমস হাউস ও বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত।
বেনাপোল কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ৫০১টি মেনিফেস্টোর বিপরীতে কোনো বিল অব এন্ট্রি দাখিল করা হয়নি। এর আগে একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে ২০২৪ সালের পুরো বছর। তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৯১টি মেনিফেস্টোর পরিবর্তে ২১৭টি মেনিফেস্টো নাম্বার সঠিক। বাকি ৬৭৪টি মেনিফেস্টোর তথ্য বেনাপোল স্থল বন্দর ও কাস্টমস ‘অ্যাসাইকুডা’ সিস্টেমে তথ্য মেলেনি।
বেনাপোল কাস্টমস হাউসের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, এসব অনিয়ম তদন্তের জন্য অভ্যন্তরীণ অডিট এবং এনবিআরের তদন্ত দল ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনও দৃশ্যমান কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
রাজস্ব ফাঁকি ও আমদানি প্রক্রিয়ায় এমন জালিয়াতি দেশের অর্থনীতি ও বৈধ বাণিজ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দ্রুত তদন্ত শেষ করে দায়ীদের চিহ্নিত ও শাস্তির আওতায় না আনলে এ ধরনের অনিয়ম ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
জাতীয় রাজম্ব বোর্ড (এনবিআর) ২০২৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বেনাপোল কাস্টমস হাউস বরাবর চিঠি দিয়ে ২০২৪ সালের ওই ৮৯১টি মেনিফেস্টোর বিষয়ে ব্যাখ্যা চায়। একই বছরের ৫ মে ফের আরেকটি চিঠি পাঠিয়ে দ্বিতীয় দফায় জানতে চাওয়া হয় কেন এসব মেনিফেস্টোর বিপরীতে কোনো বিল অব এন্ট্রি নেই। তবে এখনও পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে কোনো সন্তোষজনক জবাব মেলেনি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বন্দরসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সহায়তায় প্রায় নিয়মিতভাবেই পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো কাগজপত্র ছাড়াই দেশীয় বাজারে প্রবেশ করছে। এতে বৈধপথে আমদানিকারকরা বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। কারণ শুল্ক ফাঁকি দেয়া এসব পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় বাজারে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং দেশীয় শিল্পের জন্য হুমকি তৈরি করছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আলহাজ মফিজুর রহমান সজন বলেন, আমরা শুনেছি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশে বেনাপোল কাস্টমস হাউসে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই মেনিফেস্টো দুই থেকে পাঁচবার, ১০ বার ও ১৬ বার পর্যন্ত ব্যবহার করে একটি চক্র কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চ শুল্কের পণ্য কসমেটিকস ও ফেব্রিক্সের চালান পাচার হয়েছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি খায়রুজ্জামান মধু জানান, ভারতীয় কাস্টমস সাইডের গত এক বছরের কার্গোর রেকর্ড অর্থাৎ ইজিএমের (এক্সপার্ট জেনারেল মেনিফেস্টো) কার্গো রেজিস্টার যাচাই করলে মোট কতটি গাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, ওজন কত, কী কী পণ্য, এসব তথ্যের জট খুলবে তখন। পরবর্তীতে ক্রসচেক করলে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। তিনি আরও বলেন, আমরা ব্যবসায়ী হিসেবে চাই সঠিক তদন্তপূর্বক প্রকৃত দোষীকে আইনের আওতায় আনা হোক।
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক মো. শামীম হোসেন বলেন, কোনো কোনো মেনিফেস্টো নাম্বারের বিপরীতে একাধিক মেনিফেস্টো নাম্বারটি জমা পড়েছে। বিষয়টি আমরা তদারকি করছি এবং ভবিষ্যতে কেউ যেন এ ধরনের অসৎ পথ অবলম্বন করতে না পারে সেই বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক আছি।
বেনাপোল কাস্টমস হাউসের সহকারী কাস্টমস কমিশনার মো. রাজন হোসেন বলেন, গত ৫ মে মেনিফেস্টো দাখিল হয়েছে, কিন্তু বিল অব এন্ট্রি দাখিল হয়নি। এমন পণ্য চালানসহ নিষ্পত্তিকরণের লক্ষ্যে একটি পত্র প্রেরণ করা হলে বন্দর কর্তৃপক্ষ পত্র পর্যালোচনা করে দেখেন কিছু মেনিফেস্টোর পুনরাবৃত্তি রয়েছে। অনিয়ম ধরা পড়ায় এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির কার্যক্রম চলমান।

Discussion about this post