শেখ শাফায়াত হোসেন : ইলেকট্রনিক মানি (ই-মানি) ইস্যুর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্যে আনতে এবং এ খাতে জালিয়াতি রোধ করতে নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব আমরা এই নীতিমালা বাস্তবায়নের দিকে যেতে চাই। তবে নীতিমালায় বাস্তবায়নে ঠিক কত সময় লাগবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।’
এই নীতিমালার শিরোনাম হবেÑ‘বাংলাদেশের ই-মানি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য নীতিমালা ২০২৫’। নতুন এই নীতিমালা প্রণয়নের পেছনে কাজ করেছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) প্রোভাইডার ‘নগদ’-এর ৬৪৫ কোটি টাকা ই-মানি ইস্যু করার ঘটনাটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটি ই-মানির বিপরীতে যথাযথ মুদ্রা মজুত রাখেনি।
বর্তমানে ব্যাংক, এমএফএস ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারগুলো (পিএসপি) ই-মানি ইস্যু করতে পারে, তবে এক্ষেত্রে সমপরিমাণ নগদ অর্থ সংরক্ষণ করতে হয়।
নতুন নীতিমালার আওতায় একটি ই-মানি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানকে ‘ট্রাস্ট আইন ১৮৮২’-এর নির্দেশনার আলোকে অবশ্যই একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্টে সিস্টেমস বিভাগ এই নীতিমালার খসড়ায় এমন কিছু নির্দেশনার কথাই বলেছে। এই ট্রাস্ট ফান্ড সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টের ন্যায্যতা বজায় রাখা হচ্ছে কি না, তার দায়িত্ব নেবে। ই-মানির বিপরীতে যে টাকা জমা রাখতে হবে, তা এই তহবিলে জমা থাকবে।
বর্তমানে এমএফএস ও পিএসপির মতো ই-মানি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাংকে ট্রাস্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করছে। তবে সেক্ষেত্রে কোনো ট্রাস্ট এন্টিটি বা ফান্ড করা হচ্ছে না।
প্রস্তাবিত নীতিমালায় এ ধরনের ট্রাস্ট ফান্ডে কেবল ই-মানি ইস্যুর বিপরীতে সমপরিমাণ অর্থ জমা হবে। এই ফান্ডে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মূলধন, চলতি মূলধন বা পরিচালন তহবিল জমা হবে না।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, এই তহবিলে যে টাকা জমা হবে তার বিপরীতে ব্যাংক সুদ দিতে পারবে। নির্ধারিত মুনাফায় সরকারি সিকিউরিটিজেও বিনিয়োগ করা যাবে এই তহবিলের অর্থ।
অর্থাৎ গ্রাহকের টাকার বিপরীতে ই-মানি ইস্যু করে ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান সমপরিমাণ অর্থ ট্রাস্ট ফান্ডে জমা করে সুদ বা মুনাফা অর্জন করতে পারবে।
এই আয় থেকে ৮০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তাদের ই-মানি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে ব্যয় করতে পারবে। এতে তাদের পরিচালন ব্যয় কমে আসবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা।
এই আয় দিয়ে ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বোনাস, প্রচারণার খরচ, অথবা এ-জাতীয় কোনো ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে না।
বর্তমানে রকেট, বিকাশ ও নগদ-এর মতো ই-মানি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান চালুর ক্ষেত্রে ব্যাংক-লেড মডেল অনুসরণ করতে হয়। তবে নতুন নীতিমালায় এই ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ব্যাংক-মডেলের বাইরেও সম্ভব বলে নীতিমালায় উল্লেখ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যদের মতো টেলকো-লেড মডেল বা গুগল পে’র মতো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশেও ই-মানি ইস্যুর সুযোগ পাবে।
এভাবেই নতুন নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই নীতিমালা পাস হলে স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে আবেদন করলে ই-মানি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাইসেন্স পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন নীতিমালায় ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ থাকবে, যা নগদ লেনদেন কমিয়ে আনতে সহায়ক হবে বলে আশা করছেন তারা।
তারা আরও বলছেন, এতে ই-মানি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা বজায় থাকবে। ই-মানি সেবাও বৃদ্ধি পাবে। ই-মানি খাতের জালিয়াতি কমে আসবে। একই সঙ্গে ফিনটেক ইকোসিস্টেমস উন্নয়নের ব্যয়ও কমে আসবে বলে আশা করছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা।
নতুন নীতিমালার আওতায় ই-মানি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তিনটি পদ্ধতিতে কাজ করতে পারবে। প্রথমত, পিএসপি, যা বর্তমানে ক্যাশ-ইন এবং ক্যাশ-আউট পরিষেবা ছাড়া অন্যান্য ই-ওয়ালেট সেবা প্রদান করে থাকে।
দ্বিতীয়ত, অনুমোদিত ই-মানি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানগুলো একটি তফসিলি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একটি ব্যবসায়িক ইউনিট হিসাবে পরিচালিত হবে, যাদের ক্যাশ-ইন এবং ক্যাশ-আউট সুবিধাসহ পূর্ণাঙ্গ ই-ওয়ালেট ও ই-মানি সেবা প্রদানের এখতিয়ার থাকবে।
তৃতীয়ত, ক্যাশ-ইন, ক্যাশ-আউট সুবিধাসহ পূর্ণাঙ্গ ই-ওয়ালেট ও ই-মানি পরিষেবা প্রদানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত পৃথক করপোরেট প্রতিষ্ঠান। এই তিন ধরনের ই-মানি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা মূলধনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে।
একটি ই-মানি ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে ১০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে বলে নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, ট্রাস্ট ফান্ডের সঠিক পরিচালনা এবং ই-মানির ব্যবস্থাপনার প্রতি আস্থা বৃদ্ধির জন্য প্রথমবারের মতো এ খাতের প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটি চালুর বিষয়ে নির্দেশনা আসতে পারে।
ই-মানি ইস্যুকারীরা তাদের সংঘ স্মারকে স্পষ্ট করে জানাতে হবে যে, ট্রাস্ট ও সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টে রক্ষিত ই-মানি ব্যালেন্স অন্য কোনো তহবিলের সঙ্গে যুক্ত হবে না।
প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, এজেন্ট ব্যবস্থাপনা ও আউটসোর্সিং কার্যক্রমে আরও বেশি মানসম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশনাও থাকবে নতুন নীতিমালায়। দেশীয় বা বিদেশি মুদ্রায় প্রিপেইড কার্ড, ভ্রমণ কার্ডসহ সব ই-মানি কার্যক্রম এই নীতিমালার আওতায় আসবে। ই-মানির একটি সংজ্ঞাও এই নীতিমালায় থাকবে। তাতে ফিজিক্যাল কারেন্সি ও ই-মানির পার্থক্য এবং এর পরিচালনগত প্রক্রিয়াগুলো নির্দিষ্ট করে বলা থাকবে।

Discussion about this post