মীর আনিস : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস লিখতে গেলে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের অবদান না তুলে ধরা সম্ভব নয়। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক শুধু ব্যাংক নয়, এরা আসলে বাংলাদেশের শিল্পায়নের অন্যতম ভিত্তি। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে দাঁড় করানোর যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, তার প্রতিটি ধাপে এই চার ব্যাংক শিল্পোদ্যোক্তাদের ভরসা জুগিয়েছে। ঋণ, বিনিয়োগ, পুনঃঅর্থায়ন, এলসি কিংবা প্রকল্প ঋণ—সবখানেই তাদের দৃশ্যমান ছাপ রয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প, টেক্সটাইল, স্টিল থেকে শুরু করে খাদ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, অবকাঠামো—প্রতিটি খাতে এদের অবদান গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে আছে।
রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের সাফল্যের গল্প যেমন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ছাড়া সম্ভব ছিল না, তেমনি দেশের বহু শিল্পগোষ্ঠীর উত্থানের পেছনেও রয়েছে তাদের অর্থায়ন। হা-মীম গ্রুপ যখন টেক্সটাইল ভ্যালু চেইনের প্রতিটি ধাপ নিজের নিয়ন্ত্রণে আনে, তখন প্রয়োজন হয় বিপুল পরিমাণ যন্ত্রপাতি আমদানি, আধুনিক উৎপাদন লাইন স্থাপন এবং দীর্ঘমেয়াদি কার্যকরী মূলধনের। সোনালী বা অগ্রণীর মতো ব্যাংক সেই সহায়তা না দিলে হা-মীম আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে পারত না।
একইভাবে বেক্সিমকো গ্রুপের বিস্তৃত পরিসরের শিল্পবিস্তার—টেক্সটাইল থেকে শুরু করে ফার্মাসিউটিক্যালস, ভোক্তা পণ্য ও শক্তি—রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্রেডিট লাইন ছাড়া কখনোই এত দ্রুত ঘটত না। বেক্সিমকোর মতো শিল্পগোষ্ঠী যখন বিশ্ববাজারে নিজেদের নাম প্রতিষ্ঠা করেছে, তখন তাদের পাশে থেকেছে জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক—যারা আন্তর্জাতিক লেনদেনের নিশ্চয়তা দিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা তৈরি করেছে।
নোমান গ্রুপ বাংলাদেশের টেক্সটাইল সেক্টরে একটি উজ্জ্বল নাম। সুতা থেকে কাপড়, কাপড় থেকে তৈরি পোশাক—পুরো চেইনকে নিয়ন্ত্রণ করে তারা এক অনন্য অবস্থান তৈরি করেছে। তাদের যন্ত্রপাতি আমদানি ও নতুন ইউনিট স্থাপনে যে বিপুল অর্থায়নের প্রয়োজন হয়েছিল, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো তা নিশ্চিত করেছে। ডিবিএল গ্রুপও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে পোশাকশিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাদেরও ঋণ সহায়তার বড় অংশ এসেছে এই চার ব্যাংকের কাছ থেকে।
শুধু পোশাক খাত নয়, ভারী শিল্পের দিকেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের নজর ছিল সমানভাবে। চট্টগ্রামভিত্তিক হাবিব গ্রুপ যখন স্টিল, শক্তি, এভিয়েশনসহ বহুমুখী খাতে কাজ শুরু করে, তখন প্রকল্প ঋণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক এগিয়ে আসে। যমুনা গ্রুপ বা ওরিয়ন গ্রুপের মতো বহুমুখী শিল্পগোষ্ঠীও তাদের শুরুর দিনগুলোয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সহায়তা ছাড়া এগোতে পারত না। শিল্প স্থাপনে যে বিপুল পুঁজি দরকার, বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আনার জন্য যে এলসি সুবিধা প্রয়োজন, কিংবা প্রথম কয়েক বছরের কার্যকরী মূলধন—সবকিছুই এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের হাত ধরে।
এই ব্যাংকগুলো শুধু বড় শিল্পপতিদের জন্য নয়, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের (এসএমই) জন্যও কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যখন মূলধনের অভাবে শিল্প স্থাপন করতে পারেনি, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর শিথিল শর্তের ঋণ তাদের নতুন ভরসা জুগিয়েছে। পরে সেই ছোট উদ্যোগগুলো অনেক ক্ষেত্রে শিল্পগোষ্ঠীতে রূপ নিয়েছে। গার্মেন্টসের অসংখ্য সাব-কন্ট্রাক্টর, টেক্সটাইলের ছোট ইউনিট কিংবা স্টিল শিল্পের ক্ষুদ্র উদ্যোগ—সবখানেই এদের সহায়তা রয়েছে।
শিল্পোদ্যোক্তাদের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটেও এই চার ব্যাংকের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা বাজেট সহায়ক ঋণ দিয়েছে, অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে, সংকটকালে শিল্প প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। করোনা মহামারির সময় যখন রপ্তানিমুখী শিল্পখাত ধাক্কা খেল, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে অনেক প্রতিষ্ঠানকে পুনরুদ্ধারের সুযোগ করে দেয়।
শিল্পায়ন মানে কেবল উৎপাদন নয়, বরং কর্মসংস্থান সৃষ্টি। পোশাক খাতে লাখ লাখ শ্রমিকের চাকরি, স্টিল খাতে হাজারো প্রকৌশলী, টেক্সটাইল খাতে অগণিত কারিগর—সব মিলিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অর্থায়নই আসলে এ কর্মসংস্থানের ভিত গড়ে দিয়েছে। গ্রাম থেকে শহরে মানুষের কর্মসংস্থানের যে স্রোত তৈরি হয়েছে, তার একটি বড় চালিকাশক্তি এ চার ব্যাংকের অর্থায়ন।
অবশ্য সীমাবদ্ধতাও ছিল। খেলাপি ঋণ, রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা দুর্বল করপোরেট গভর্ন্যান্সের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অনেক সময় সমালোচনার মুখে পড়েছে। তবুও দেশের শিল্পায়নের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে তাদের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। যদি কোনো শিল্পগোষ্ঠী আজ দেশের নাম বিশ্বে উজ্জ্বল করে, তার পেছনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রাথমিক সহায়তা একটি অনিবার্য সত্য।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা যে আজ বৈশ্বিক স্বীকৃতি পাচ্ছে, তাতে সরকারের নীতি, উদ্যোক্তাদের সাহস এবং শ্রমিকদের ঘাম যতটা গুরুত্বপূর্ণ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অর্থনৈতিক সহায়তা ও কাঠামোগত ভূমিকা ততটাই অপরিহার্য। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী—এই চারটি ব্যাংক আসলে শিল্পায়নের নীরব স্থপতি। তাদের অবদান না থাকলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস হয়তো আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত হয়ে উঠত না, কিংবা স্টিল শিল্প বা ফার্মাসিউটিক্যালস এতটা দ্রুত বিস্তার লাভ করত না।
এখনকার দিনে যখন বেসরকারি ব্যাংকগুলো আধুনিক প্রযুক্তি ও দ্রুত সেবার কারণে আলোচনায় থাকে, তখনও ভুলে গেলে চলবে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সেই ঐতিহাসিক অবদান। বাংলাদেশের প্রতিটি শিল্পগোষ্ঠীর সাফল্যের গল্পে তাই অদৃশ্যভাবে লেখা আছে—সোনালী, জনতা, অগ্রণী আর রূপালীর নাম।
প্রিন্ট করুন










Discussion about this post