মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর : যশোরের কেশবপুরে বেড়ে চলেছে ঐতিহ্যবাহী কালোমুখ হনুমানের সংখ্যা। এক সময় বিলুপ্তপ্রায় এ প্রজাতির হনুমান নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলেও এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট ও নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব। তাছাড়া তারা নিজেরাও প্রায়ই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সব মিলিয়ে এসব হমুমানের বড় একটা অংশ এলাকা ছেড়ে আশপাশের উপজেলা ও জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা, বন বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে কেশবপুরে কালোমুখ হনুমানের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার শতাধিক। উপজেলা বন কর্মকর্তা সমীরণ বিশ্বাস জানান, শুধু উপজেলা পরিষদ চত্বরেই শতাধিক হনুমানের দেখা মেলে। উপজেলা হাসপাতাল এলাকা, বালিয়াডাঙ্গা মন্দির, হরিহর নদীর ধারের মহাশ্মশান, খতিয়াখালী ও পুলেরহাট বাজার-এসব এলাকাতেও তাদের বিচরণ বেড়েছে।
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ দপ্তর জানায়, এই প্রজাতির হনুমান প্রায় দুই শতাব্দী ধরে কেশবপুর ও মণিরামপুর অঞ্চলে বসবাস করছে। তাদের গড় আয়ু ১৮ থেকে ৩০ বছর। সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর এবং ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই প্রাণীটির প্রজনন মৌসুম। স্ত্রী হনুমান ২০০ থেকে ২১২ দিন গর্ভধারণের পর এক থেকে দুটি বাচ্চা প্রসব করে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন)-২০১২ অনুযায়ী, কালোমুখ হনুমান সংরক্ষিত প্রজাতির তালিকাভুক্ত। এর বৈজ্ঞানিক নাম সিমনোপিথিকাস এনটিলাস।
কেশবপুর পৌরসভার বাসিন্দা রেজাউল করিম বলেন, ‘কালোমুখ হনুমান আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু নিরাপদ আশ্রয় আর পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে এখন তারা অন্যত্র যাচ্ছে। সরকার চাইলে তাদের সংরক্ষণে বড় পদক্ষেপ নিতে পারে।’
বালিয়াডাঙ্গা মোড়ের ব্যবসায়ী মো. সেলিম বলেন, ‘খাবারের অভাবে প্রায়ই তারা দোকানে ঢুকে খাবার নিয়ে যায়। কয়েকদিন আগে আমার দোকান থেকে ২০ থেকে ২৫ প্যাকেট চিপস নিয়ে পালিয়েছে।’
একই অভিজ্ঞতার কথা বললেন সুজাপুরের কৃষক আব্দুল হালিম। তার ভাষায়, ‘আমার ঘরের টালি ভেঙে ভেতরে ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করেছে। খুব অত্যাচার করে ওরা।’
স্থানীয় সূত্র জানায়, একসময় একটি বেসরকারি সংস্থা হনুমানদের জন্য ফলদ ও বনজ বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু অতিবৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় প্রকল্পটি টিকেনি। ফলে খাদ্যাভাব, আশ্রয় সংকট, বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে মৃত্যু এবং মানুষের নির্যাতনে প্রায়ই হনুমান মারা যাচ্ছে। কথিত আছে, ব্রিটিশ আমলে দক্ষিণ ভারতের কয়েকজন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ব্যবসার উদ্দেশ্যে কেশবপুরে এসে সঙ্গে করে কয়েকটি কালোমুখ হনুমান এনেছিলেন। সেগুলোই বংশবৃদ্ধি করে আজকের ‘হনুমান নগরী’র রূপ নিয়েছে। স্থানীয় প্রবীণরা জানান, স্বাধীনতার আগে এখানে প্রায় দুই হাজারের মতো হনুমান ছিল। বন উজাড়, গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া ও মানুষের অত্যাচারে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদারের কর্মচারী আতিয়ার রহমান হনুমানদের জন্য নিয়ে এসেছেন পাকা কলা, বাদাম, বনরুটি ও আলু। তিনি জানান, প্রতিদিন পাঁচটি স্পটে সকাল-বিকাল দুই দফায় খাবার দেয়া হয়। খাবারের মধ্যে থাকে-৪৭ কেজি পাকা কলা, ৬ কেজি ৭০০ গ্রাম বনরুটি, ৭ কেজি ৩০০ গ্রাম বাদাম, ৬ কেজি ৮০০ গ্রাম আলু এবং পালাক্রমে বিভিন্ন সবজি। তিনি বলেন, প্রায় ১৮ বছর ধরে আমি হনুমানদের খাবার দিচ্ছি।
খাবার সরবরাহকারী তুহিন এন্টারপ্রাইজের মালিক ইয়াসির আরাফাত সান জানান, ‘দুই বছর ধরে টেন্ডারের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করছি। প্রতিদিন উপজেলা পরিষদ থেকে মেপে খাবার দেয়া হয়, তাই কারচুপির সুযোগ নেই।’
সামাজিক বন বিভাগের যশোর রেঞ্জ অফিসার এম এম মিজানুর রহমান বলেন, ‘কেশবপুরে চার শতাধিক হনুমান আছে। তবে তারা এক জায়গায় স্থায়ী থাকে না। প্রতিটি দলে এক বা দুটির বেশি পুরুষ হনুমান থাকলে নিজেরাই সংঘর্ষে জড়িয়ে অন্যত্র চলে যায়। অভয়ারণ্য তৈরি করলেও তাদের আটকে রাখা কঠিন।’
তিনি আরও জানান, সরকারি ব্যবস্থাপনায় হনুমানদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে। সামাজিক বন বিভাগের আওতায় কেশবপুর ও ঝিনাইদহের মহেশপুরে খাবারের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। আগামী মাসে নতুন টেন্ডার আহ্বান করা হবে।
‘প্রতিবছর খাবার বাবদ প্রায় ২০ লাখ টাকার বরাদ্দ থাকে, যার মধ্যে কেশবপুরেই ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়,’ বলেন তিনি।
স্থানীয়রা বলছেন, হনুমান শুধু কেশবপুরের ঐতিহ্য নয়, এ অঞ্চলের মানুষের আবেগের অংশও। তাই এই বন্যপ্রাণীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা মানে প্রকৃতি ও ঐতিহ্য দুটোই রক্ষা করা।
প্রিন্ট করুন




Discussion about this post