রেজাউল করিম খোকন : ঊনসত্তরে সেই অভ্যুত্থানের সময় ঢাকার চিত্র, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। সেনাশাসক এরশাদ যেদিন বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগ করে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেনানিবাসে ফিরে গেলেন, সেদিন ঢাকা শহর ছিল মিছিলে মিছিলে একাকার। কিন্তু চব্বিশের মিছিলের সঙ্গে সেই মিছিল, চব্বিশের গণজাগরণের সঙ্গে সেই গণজাগরণের কোনো তুলনা হয় না। সেবার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থি জোটসহ বিভিন্ন দল। এরশাদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন পেশাজীবীরাও। কিন্তু চব্বিশের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি। প্রচলিত ছাত্রসংগঠনও সেভাবে রাস্তায় নামেনি। নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা সেই অর্থে ছাত্রনেতা ছিলেন না। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যাদের কেউ কেউ ছাত্রসংগঠন করলেও বেশির ভাগ ছিলেন সাধারণ ছাত্রছাত্রী। আন্দোলনের নেতৃত্বেও তারা বিরল যূথবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন। শতাধিক সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়ক নিয়ে অতীতে কোনো আন্দোলন এ দেশে গড়ে ওঠেনি। ডিবি অফিসে আটক থাকা ছয় সমন্বয়ককে দিয়ে সরকার কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ানোর পরও তাদের মধ্যে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হয়নি। শুরুতে তাদের আন্দোলনটি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের নিরীহ দাবিতে। ২০১৮ সালেও কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে জয়ী হয়েছিলেন। আদালতের এক রায়ে তাদের সেই জয় যখন ছিনিয়ে নেয়া হলো, তখনই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলেন। তাদের যখন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হলো, তখন ক্ষুব্ধ হলেন। যেই তরুণরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, তাদের বয়স ২০ থেকে ২২ বছর। স্বাধীনতার অনেক পরে তাদের জন্ম। আন্দোলনকারী অনেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। সেই তরুণদের রাজাকারের নাতি কিংবা বাচ্চা বলে উপহাস করা কোনোভাবে মানতে পারেননি। মধ্যরাতের নীরবতা ভেঙে হল ছেড়ে দলে দলে সড়কে বেরিয়ে এলেন। তখন পর্যন্ত আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। অশান্ত হয়ে উঠল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উসকানিমূলক কথায়, যখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা চালাল। সেই থেকে ক্যাম্পাসের আন্দোলন বৃহত্তর রাজপথে ছড়িয়ে যায়। ৯ দফার আন্দোলন ১ দফা অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগে গড়ায়। এরপরের কয়েক দিন ঢাকার রাজপথ নয়, সমগ্র দেশ হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের মুক্তাঙ্গন। শিক্ষার্থীদের ছাত্র-জনতার সমাবেশ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। শিশুকে কোলে নিয়ে মা-বাবা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, তরুণ, নারীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এসেছিলেন মুক্তির স্বাদ পেতে। তখন শহিদ মিনারকেই মনে হয়েছিল গণতন্ত্রের মুক্তমঞ্চ। বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে এসেছিলেন অফিসফেরত সরকারি কর্মকর্তারাও। দলে দলে ভাগ হয়ে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন। গান গেয়ে, সড়কে ছবি এঁকে, সেøাগান দিয়ে তারা ছাত্রদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছিলেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সরকারের জবরদস্তির বিরুদ্ধে। দলে দলে লোক শাহবাগের দিকে যাচ্ছেন। সেখানেও শিক্ষার্থী-তরুণদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, মুদিদোকানি, হকার, কে নেই সেই মিছিলে? একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়ে ওঠে রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে। তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন মোকাবিলায় সরকারি দলের নেতাকর্মীরা পিস্তল, বন্দুক নিয়ে যে তাণ্ডব চালায়, তাতে একদিনেই শতাধিক মানুষ মারা যান। এর আগেও আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় নেতাকর্মীদের গুলিতে দুই শতাধিক মানুষকে জীবন দিতে হয়। শিক্ষার্থীদের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি কেন্দ্র করে সারাদেশে সর্বাত্মক গণজাগরণ ঘটে। সরকারের কারফিউ উপেক্ষা করে সকাল থেকে ঢাকায় জনস্রোত আসতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে দলে দলে হাজার হাজার লোক ঢাকায় প্রবেশ করেন। বিভিন্ন স্থান থেকে খবর আসতে থাকে, মহাখালীতে এত মানুষ জড়ো হয়েছেন। গাবতলী থেকে মিছিল করে মানুষ আসছেন। এ পর্যায়ে ঢাকার সব কটি প্রবেশপথ হয়ে ওঠে মানুষের কাফেলা। কারওয়ান বাজারে দেখা যায়, দলে দলে লোক শাহবাগের দিকে যাচ্ছেন। সেখানেও শিক্ষার্থী-তরুণদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, মুদিদোকানি, হকার, কে নেই সেই মিছিলে? উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছিল জন¯্রােত। এরই মধ্যে খবর এলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন ত্যাগ করেছেন। মুহূর্তে দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে ছুটলেন সবাই। গণভবন অভিমুখে। কেবল এই সড়ক থেকে নয়, ঢাকা শহরের সব দিক থেকে গণভবনের দিকে মানুষ যাচ্ছে। যাচ্ছেই। শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শুধু নয়, সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
সেদিন রাতারাতি বদলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। স্বৈরাচার হিসেবে জনতার রোষে যাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হলো, এক মাস আগেও তার পরিবর্তন সম্ভব, এমন ভাবনা আমাদের মাথায় ঢোকেনি। শুধু যে ক্ষমতার প্রতিটি ক্ষেত্রে এই স্বৈরাচার তার নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিলেন তা-ই নয়, আমাদের চিন্তার রাজ্যেও তার আধিপত্য ছিল প্রায় নিরঙ্কুশ। ইতিহাস সাক্ষী, সবচেয়ে ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যও অনন্তকাল ক্ষমতায় টিকে থাকে না। ক্ষমতার দম্ভ ও সব বিরোধিতা দমনে সাফল্য শুধু যে ঔদ্ধত্যের জš§ দেয় তাই নয়, শাসককে অন্ধ করে ফেলে। এখানে এত দীর্ঘ সময় নির্মম দক্ষতায় তারা যে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন, তার অন্যতম কারণ একটি তাঁবেদার ক্ষমতাভোগী গোষ্ঠীর নিঃশর্ত সমর্থন। এই ক্ষমতাভোগীদের মধ্যে রয়েছে প্রশাসনের সদস্য, পেশাদার রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের উল্লেখযোগ্য অংশ। জেনারেশন জেড নামে পরিচিত আন্দোলনকারী ছাত্রদের অভিনন্দন জানাই। আমরা অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলাম, আমাদের জীবদ্দশায় দেশ দুঃশাসনমুক্ত হবে না। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে দেশ ১৬ বছরের দীর্ঘ স্বৈরাচার, অপশাসন ও নির্যাতন থেকে রাহুমুক্ত হয়েছে। এ দীর্ঘসময়ে নানান আন্দোলন-সংগ্রাম হলেও তা হালে পানি পায়নি। কিন্তু ছাত্ররা কেন সফল হলো, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ছাত্রদের আন্দোলনের সাফল্যের প্রধান কারণ তিনটি। এক. অন্য আন্দোলন-সংগ্রামগুলোর লক্ষ্য ছিল একটি স্থিতাবস্থার পরিবর্তে আরেকটি বিকল্প স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যাতে সবকিছুই আগের মতো থাকবে। কেবল নাটকের কুশীলব পরিবর্তন হবে, নতুন রাজা-রানি, যুবরাজ, পাইক-পেয়াদা দই-মাখন খাবে। শোষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, ঘুষ, দুর্নীতি ও অপশাসন যথারীতি অব্যাহত থাকবে। এর বিপরীতে ছাত্রদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল খোলনলচে বদলে ফেলা, শোষণ, নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। দ্বিতীয় কারণটি হলো, আন্দোলনের শুরু থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও প্রাণশঙ্কার কথা জেনে সুইসাইড মিশন নিয়ে তাদের রাস্তায় নেমে পড়া। আমরা কি আসলেই জীবিত ছিলাম? একবার অন্তত বাঁচার চেষ্টা করিÑতেমন প্রত্যয় ছিল তাদের মধ্যে। হালুয়া-রুটির ভাগাভাগিতে আগ্রহী অন্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে এ ধরনের প্রত্যয় ও আত্মত্যাগের মানসিকতা দেখা যায়নি। সর্বশেষ কারণটি হলো, তাদের পূর্বপ্রস্তুতি। আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও অংশগ্রহণকারী জেনারেশন জেড বলে অভিহিত ছাত্ররা ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২৪ সালের আন্দোলনে উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করেছিল এবং জনগণ তাতে সাড়া দিয়েছিল। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের আন্দোলনগুলো ছিল গতানুগতিক। তারা এমন একটি সমাজ ও জাতি চায়, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যও ছিল তা-ই। যেহেতু সরকারি চাকরির সংখ্যা সীমিত, তাই তাদের দাবি ছিল প্রধানত মেধার ভিত্তিতেই নিয়োগ প্রদান করতে হবে। এই প্রজš§ একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। ছাত্ররা তাদের সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেছে।
লুণ্ঠন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়াও গত ১৬ বছরের অপশাসনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো বিচার বিভাগ, সংসদীয় ব্যবস্থা, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, সাংবাদিকতাসহ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে, অবাধ দুর্নীতির সুযোগের বিনিময়ে এগুলোয় পদলেহী ও আজ্ঞাবহ দুর্বৃত্তদের শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রদান। তাই এখন একটি বড় কাজ হবে, এসব জঞ্জাল অপসারণ ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ। সংস্কারগুলো না করে কেবল নির্বাচন করলে তা অর্থবহ হবে না বা জনপ্রত্যাশা পূর্ণ করবে না। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা অন্যের জবাবদিহি চাই, কিন্তু নিজেরা জবাবদিহি করতে চাই না। বিচার বিভাগ, সংসদীয় ব্যবস্থা, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, সাংবাদিকতাসহ সব প্রতিষ্ঠান সৎ ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত না হলে দুর্নীতির করালগ্রাস থেকে জাতিকে বাঁচানো যাবে না। অতীত সরকারের দুর্নীতি ছাড়াও ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতিমুক্ত রাখার জন্য তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। সব ক্ষেত্রেই পুঁথিগত বিদ্যা অপেক্ষা উপদেষ্টাদের প্রায়োগিক জ্ঞান ও কর্মজীবনে সফলতা বা অর্জনের ওপর জোর দিতে হবে। ছাত্রদের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংসদ পরিচালনা করে জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা কেউ চাই না সাম্প্রতিক আন্দোলনে শহিদদের আত্মদান বৃথা যাক। জেনারেশন জেড-সূচিত বিপ্লব সফল হোক। আমরা যা পারিনি, সেটা করে দেখিয়েছে নতুন প্রজন্মের। এই মুহূর্তে আমাদের সবার দায়িত্ব তাদের সে স্বপ্নযাত্রায় সমর্থন দেয়া, তাদের সফরসঙ্গী হওয়া। এরা ব্যর্থ হলে ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ জায়গাটুকুও আমাদের হাতছাড়া হবে। দীর্ঘ স্বৈরাচারী আমলে যখনই দুঃশাসনের সমালোচনা উচ্চারিত হয়েছে, এমনকি সামাজিক বৃত্তে সীমাবদ্ধ সে সমালোচনাও তারা প্রত্যাখ্যান করেছেন এই যুক্তিতে যে এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সে কারণে তাদের কোনো বিকল্প নেই। স্বৈরাচার, যার একমাত্র লক্ষ্য যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকা, সে যে কখনও মুক্তিযুদ্ধের ধারক হতে পারে নাÑএই সাধারণ সত্যটুকুও তাদের বিবেচনায় প্রবেশ করেনি। ফলে এখন এমন দাবি করা মোটেই অযৌক্তিক নয়, সুবিধাভোগী এই তাঁবেদার গোষ্ঠীও স্বৈরাচারের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও অপশাসনের জন্য দায়ী। একাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে, তারা বরাবরই নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারী হিসেবে বৈধতা দাবি করেছে। ক্ষমতার শীর্ষে যারা অবস্থান নেন, তারা প্রায় সবাই ছিলেন বিগত শতকের রাজনীতিক। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নেতৃত্বে প্রজন্ম গত কোনো পরিবর্তন আসেনি। এর ফলে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে তাদের ব্যবধান বেড়েছে, সৃষ্টি হয়েছে অনপনেয় দূরত্ব। বিগত প্রজন্ম তাদের ক্ষমতা ও সুবিধাভোগ চিরস্থায়ী করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যে অপব্যবহার করেছেন, নব প্রজন্মের মনে তা গভীর প্রত্যাখ্যানের জš§ দিয়েছে। আরও একটি পরিবর্তন আমাদের অলক্ষ্যে জন্ম নিয়েছে। নতুন যে প্রজন্ম , যারা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ ও বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত, বাংলাদেশের স্থবির রাজনৈতিক বাস্তবতাকে একমাত্র সত্য হিসেবে মানতে তারা প্রস্তুত ছিল না। তারা আরব বসন্তের কথা পড়েছে। লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে এক নবীন নেতৃত্বের আবির্ভাব দেখেছে। যুক্তরাজ্যে রক্ষণশীলদের নির্বাচনী বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষদর্শী তারা। ‘পরিবর্তন সম্ভব’, এটি তাদেরই স্লোগান। বাংলাদেশে এই নতুন প্রজন্মের হাতেই ঘটল অভাবিত এক বিপ্লব। তবে শিক্ষার্থী ও নব প্রজন্মের প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হলো, তাকে ‘বিপ্লব’ বলা যায় কি না, তা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। বিপ্লব মানে বিগতের সঙ্গে পূর্ণচ্ছেদ। আওয়ামী সরকারের পতনের পর যে কদিন গেছে, তা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলার সময় হয়তো আসেনি, কিন্তু একটি লক্ষণ বা প্রবণতা নজরে পড়ছে। স্বৈরাচার পতনের পরমুহূর্ত থেকেই ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের জন্য আঁক কষা শুরু করেছে পুরোনো, প্রত্যাখ্যাত রাজনৈতিক স্বার্থবাদী মহল। নতুন যে প্রজন্মের হাতে পরিবর্তন সূচিত হলো, তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, এমন সম্ভাবনায় অথবা আশঙ্কায় তারা মোটেই উদ্বিগ্ন নন। যে দুর্নীতিমুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক সুশাসিত বাংলাদেশের কথা তারা ভাবছেন, সে রূপরেখার সঙ্গে সম্মতি পোষণ করে এমন সবাই তাদের কাছে আমন্ত্রিত। যারাই পুরোনো বাংলাদেশকে পুনরাবিষ্কারে আগ্রহী হবে, যারা গতকালের অন্ধকূপে আবারও আমাদের ঠেলে দিতে চাইবে, তারাও সদ্য পলাতক স্বৈরাচারের ভাগ্য বরণ করবে, এমন সাহসী ঘোষণা তারা দিয়েছেন। আমরা নতুন প্রজন্মের এই ঘোষণায় ও তাদের নেতৃত্বে আস্থাবান। আমরা যা পারিনি, তারা সেটা করে দেখিয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের সবার দায়িত্ব তাদের সে স্বপ্নযাত্রায় সমর্থন দেয়া, তাদের সফরসঙ্গী হওয়া। এরা ব্যর্থ হলে ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ জায়গাটুকুও আমাদের হাতছাড়া হবে।
শেখ হাসিনার সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ঘটনা এখন প্রতিনিয়ত সামনে আসছে। রাষ্ট্রীয় সেবাদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে গেঁড়ে বসা দুর্নীতি মোকাবিলা করতে হবে। দেশের মানুষ আওয়ামী আমলের গোষ্ঠীপ্রীতি থেকে কতটা মুক্তি পেল এবং অতঃপর তারা বৈষম্যহীন আর্থসামাজিক সুযোগ পাওয়ার সুযোগ ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কাছ থেকে যথাযথ সেবা পাচ্ছে কি না, সে মূল্যায়নের সময় কিন্তু এসে গেছে। প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ধরে যা চলছিল, তা স্থিতিশীলতা নয়, ভীতি প্রদর্শনের সংস্কৃতিতে গড়া অপশাসনের শৃঙ্খল। ওই ব্যবস্থার প্রতি ন্যূনতম গণ-আস্থা থাকলে জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে তা খান খান হয়ে যেত না। তারপরও এখনকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভুলে গেলে চলবে না, শেখ হাসিনার ‘স্মৃতি কেউ ভোলে না, কেউ ভোলে’। হাসিনা এখন অতীত। তার শাসনামলে হারিয়ে যাওয়া গণমানুষের আস্থা ও আশাবাদ ফেরানোর প্রতিশ্রুতি নিয়েই ক্ষমতার দৃশ্যপটে হাজির হয়েছিলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও রক্ত ঝরার বেদনা বিপ্লবের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটায়। এই অভাবনীয় ঘটনার ফলে জনমনের প্রাথমিক স্বস্তি ইউনূস সরকারের জন্য ছিল সুবিধাজনক অবস্থান, কৃতিত্ব নয়। একটি নষ্ট ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার পর সুষ্ঠু, কার্যকর একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই ছিল প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের টিমের সামনে। ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের উত্থান রোধ করতে এখনই রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। ইউনূস সরকারের উদ্যোগগুলো, বিশেষ করে সংস্কার কার্যক্রমকে, টেকসই বা কালজয়ী করতে হলে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতিশ্রুতি ও অংশীদারত্ব অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে কমিউনিকেশন গ্যাপ বা কিছুটা অনিশ্চয়তা মানুষকে আশাহত করে। প্রফেসর ইউনূসের সরকার, তার উপদেষ্টাসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যে শুধু অন্তর্র্বর্তী প্রশাসনের দাপ্তরিক কাজ করবেন তা নয়; তারা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করবেন, এমনটাই কাক্সিক্ষত। শেখ হাসিনার পরাজিত ও ক্রুদ্ধ সমর্থকরা প্রফেসর ইউনূসকে স্বৈরাচারী বা সংবিধানবহির্ভূত শাসক আখ্যা দিলে তাতে তার ও বাংলাদেশের মানুষের অবাক ও বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। ফ্যাসিবাদের বিষবৃক্ষ ও তার ডালপালা গজানোর ভবিষ্যৎ সুযোগ থাকাটা মোটেও কাম্য নয়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ঠিক করার পথে এই সরকার যদি রাজনৈতিক অংশীজনের সম্মতিসহ শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়, জনগণ আস্থা হারাবে না। ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের উত্থান রোধ করতে এখনই রাজনৈতিক ঐকমত্য চাই।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক

Discussion about this post