গ্রিনওয়াশিংয়ের শিকার হচ্ছিনা তো?

নুসরাত জাহান পন্নি : অরগানিক ফুড, হারবাল মেডিসিন, হার্বাল কসমেটিক্স, পিওর ফুড, মিনারেল ওয়াটার, ইকো প্রডাক্ট এ শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা মোটামুটি সবাই পরিচিত। কিন্তু আসলেই কি তাই, নাকি দিনের পর দিন গ্রিনওয়াশিংয়ের শিকার হচ্ছি আমরা? প্রশ্ন উঠতে পারে গ্রিনওয়াশিং কী? গ্রিনওয়াশিং হলো এমন এক মগজ ধোলাই প্রক্রিয়া; যেখানে ভোক্তার সামনে যে কোনো পণ্যকে অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব হিসেবে দেখানো হয়, কিন্তু আসলে পণ্যটি সেরকম নয়, ক্ষেত্রবিশেষে উল্টোটিও হতে পারে।

১৯৮৫ সালে পরিবেশ সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে একটি বিজ্ঞাপনের সিরিজ বের হয়, যার নাম পিপল ডু (চবড়ঢ়ষব ফড়) ক্যাম্পেইন, যেখানে দেখানো হয় শ্রমিকরা স্থানীয় বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে কীভাবে জমির আকার পরিবর্তন করছে। ১৯৯১ সালে এই বিজ্ঞাপনের সিরিজটি ‘ঊভভরব অফাবৎঃরংরহম অধিৎফ ভড়ৎ ঊপড়-সধৎশবঃরহম’ পুরস্কারও লাভ করে। কিন্তু একটু ঘাঁটাঘাঁটি করলেই জানা যাবে এর আসল উদ্দেশ্য। এ ধরনের ক্যাম্পেইন মূলত বড় বড় কিছু কোম্পানির মারাত্মক পরিবেশ দূষণকে আড়াল করার একটি অন্যতম অস্ত্র।

১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানি শেভরনের শোধনাগার থেকে মিলিয়ন ব্যারেল তেল লিক হওয়ার মাধ্যমে স্থানীয় ভূগর্ভস্থ পানির দূষিত হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়। তিন বছর পরে তাদের আরেকটি প্লান্ট থেকে বিষাক্ত পদার্থ নির্গমনের অভিযোগে আইনিভাবে মিটমাট করার জন্য পাঁচ লাখ ৫০ হাজার প্রদান করতে হয়। আবার ১৯৯১ সালে ক্লিন ওয়াটার অ্যান্ড ক্লিন এয়ার অ্যাক্টের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় তাদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিশোধ করতে হয়। ফলে তাদের ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া পাবলিক ইমেজ রক্ষা করার জন্য বছরে পাঁচ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ১৯৮৫ সালে তারা পিপল ডু ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে, যার প্রতি ৩০ সেকেন্ড বিজ্ঞাপনের জন্য প্রায় দুই লাখ ডলার খরচ করা হয়, যেগুলো প্রজাপতি সংরক্ষণের মতো উদ্যোগকে উৎসাহ দেয়। কিন্তু মূলত এসব প্রকল্পে বছরে মাত্র পাঁচ হাজার ডলার খরচ হয়। এ ধরনের ক্যাম্পেইন বিভিন্ন করপোরেশনের জন্য অনেক কমন, আর যদি সেটা মাল্টিন্যাশনাল কোনো করপোরেশন হয়। তারা তাদের বিক্রি বাড়ানোর জন্য এবং ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করার জন্য গ্রিনওয়াশিং করে থাকে, বা পরিবেশ নিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে থাকে। কিন্তু আদতে পরিবেশ ধ্বংসের পেছনে তাদেরই ভূমিকা ব্যাপক।

এরকম আরও কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি এক্সন মবিল, হোম ডিপো, নেসলে  প্রভৃতি। তারা ক্রমে ভোক্তাদের বিশ্বাস করাচ্ছে যে, তারা যেসব পণ্য বিক্রি করছে বা এককথায় তাদের কোম্পানি সামাজিক এবং পরিবেশগত ইতিবাচক পরিবর্তনের সহায়তা করছে। কিন্তু একটু অনুসন্ধান করলেই দেখা যাবে যে, ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন।

এখন প্রশ্ন হলো কেন এসব খ্যাতনামা  প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে বেড়ায়? সালটা ছিল ১৯৭০, যখন সরকারি বিভিন্ন বিধিনিষেধ এবং আইন পাস করা হচ্ছিল পরিবেশ ও মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু নিওলিবারেল অর্থনীতির জনক মিলটন ফ্রিডম্যান ব্যাপারটাকে বেশ ভিন্নভাবে দেখেছিলেন। তার মতে, এই বিধিনিষেধগুলো কেবল বিভিন্ন করপোরেশনের ক্ষতিই করছে না, বরং তাদের এমন কিছু করতে বাধ্য করছে, যা তাদের করার কথা নয়। তার মত অনুযায়ী, এই করপোরেশনগুলোর একমাত্র সামাজিক দায়িত্ব হলো তাদের শেয়ারহোল্ডারদের মুনাফা দেয়া। ফ্রিডম্যানের মতে, এই ধরনের বিধিনিষেধ শুধু উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে প্রলম্বিত করছে। এটাই মূলত নিওলিবারেলিজম যা মূলত নিয়ন্ত্রণমুক্ত মুক্তবাজার অর্থনীতির থিওরি প্রদান করে, যেটা কিনা বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভিত্তি। এর মূল বক্তব্য হলো সবকিছুর ওপরে মুনাফা। আর এ কারণে গ্রিনওয়াশিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করা করপোরেট মুনাফা বৃদ্ধির স্বার্থে খুব একটা ক্ষতিকর বলে তাদের কাছে মনে হয় না। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে একটি কোম্পানির প্রাথমিক লক্ষ্য হলো শেয়ারহোল্ডার এবং পুঁজিবাদী শ্রেণির জন্য মুনাফা অর্জন করা। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে পরিবেশ বা শ্রমিক শ্রেণির মানুষের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়া মানেই আরও কম বিনিয়োগকারী, কম মুনাফা এবং সর্বোপরি দেউলিয়াত্ব। যা-ই হোক, বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি, যেমন নেসলে, এইচঅ্যান্ডএম ও শেভরনকে যখন আমরা গণসংযোগ (চজ) ক্যাম্পেইন এবং আকর্ষণীয় বিপণনের মাধ্যমে পরিবেশ কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখি, যদিও তাদের কার্যক্রম ঠিক তার উল্টো, তাহলে বুঝে নিতে হবে যে, তারা আসলে তাদের মুনাফা ধরে রেখেছে, ক্ষেত্রবিশেষে সেটা আরও বেড়েছে।

তবে গ্রিনওয়াশিং আরও কিছু কাজ করেছে। প্রথমত, এটি জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্লাইমেট অ্যাকশনের ধারণাই পাল্টে দিয়েছে। বড় তেল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তেল নির্গমন এবং ছড়ানোর মাধ্যমে তারা যা ক্ষতি করছে, সেই বিষয়গুলো থেকে মানুষের ব্যক্তিগত কার্বন নিঃসরণের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করছে। তারা পরিবেশ দূষণের জন্য বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানির বদলে মানুষের ব্যক্তিগত অবস্থানকে দায়ী করছে। তারা বিভিন্ন শব্দগুচ্ছ, যেমন ইকো-ওয়ারিয়র বা ক্লাইমেট ক্রুসেডার প্রভৃতি বিশেষণ ব্যবহারের মাধ্যমে ভোক্তাদের তাদের কাছ থেকে বেশি বেশি পণ্য কিনতে উদ্বুদ্ধ করছে। এ ধরনের মার্কেটিং স্কিম আমাদের এটা ভাবাচ্ছে যে, আমরা এগুলোর মাধ্যমে পরিবেশের কোনো ক্ষতি করছি না। কিন্তু বাস্তবিকভাবে এই কোম্পানিগুলোই এই সামাজিক সমস্যার মূল হোতা।

দ্বিতীয় ভয়ংকর দিক হলো, এটি আমাদের একটা মিথ্যা নিরাপত্তার অনুভূতিতে মত্ত রাখে। আমরা ভাবি কোম্পানিগুলো তো পরিবেশ-সহায়ক কাজই করছে। ফলে আমরা তাদেরকে তাদের কাজ করতে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকি। এটাই ছিল মূলত শেভরনের পিপল ডু ক্যাম্পেইনের মূল উদ্দেশ্য। সান ফ্রান্সিসকোর পাবলিক মিডিয়া সেন্টারের পরিচালক চাও গুনটার উল্লেখ করেন, এ ধরনের বিভ্রন্তিকর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শেভরন জোর দিয়েছে যে, হয়তো আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রক কাঠামোর কিংবা সংস্থার প্রয়োজন নেই। কেননা তেল কোম্পানিগুলোই এসব দেখে নেবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, যদি এসব কোম্পানি নানা কৌশলে আমাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারে যে, তারা ভালো কিছু করছে, তাহলে তারা যা ইচ্ছা তা করতে পারবে। কারণ যেকোনো প্রকৃত পরিবর্তন, যেকোনো কার্যকর ক্লাইমেট অ্যাকশনের মানে হলো পুঁজিবাদী এই ধারাকে পরিবর্তন করে ফেলা। জলবায়ু সংকটের প্রকৃত সমাধান যেমন স্থানীয় কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করা, কৃষি অর্থনীতি এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি এ সবকিছুই কোম্পানিগুলোর জন্য দুর্যোগ বয়ে আনবে। কেননা এর মানে হলো মুনাফার চেয়ে মানুষ ও পরিবেশকে প্রাধান্য দেয়া। এই কোম্পানিগুলো মুখে যাই বলুক না কেন তাদের কার্যক্রম তাদের কথার চেয়ে সত্যটা বেশি জানান দেয়।

শুধু শেভরনই একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়, যারা দাবি করে যে তারা পরিবেশের জন্য ভালো কিছু করছে; কিন্তু আদতে করছে তার উল্টোটা। আর একটা প্রতিষ্ঠান হলো হোম ডিপো, যাকে দুই কোটি ৪০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে অবৈধভাবে বিষাক্ত বজ্র পদার্থ নিঃসরণের কারণে, যদিও তারা ভোক্তাদের কাছে তাদের ব্যবহার করা পণ্য রিসাইকেল করার জন্য ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে থাকে। আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো নেসলে যারা টেকসই পানি ও প্যাকেজিংয়ের দাবি করে। তাদের কতটুকু আসলে টেকসই, সেটা কি আমরা জানতে চেয়েছি কখনও? নেসলে ছাড়াও কোকাকোলা ও পেপসির মতো প্রতিষ্ঠান যেসব পানি বা সফট ড্রিংক প্লাস্টিকের বোতলে মোড়কজাত করে বিক্রি করে, তারা মূলত সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে ছড়াচ্ছে। অর্থাৎ এসব প্লাস্টিক একবারের বেশি সাধারণত ব্যবহার করা হয় না। আরও বড় ব্যাপার হলো নেসলে আবার অৎৎড়যিবধফ ধিঃবৎ-এ ভর্তুকি দিয়ে থাকে, যার পানির প্রধান উৎস হলো ক্যালিফোর্নিয়ার একটি এলাকা, যা কিনা ব্যাপক খরার জন্য পরিচিত। ফলে সেই এলাকার পরিস্থিতি ক্রমেই আরও খারাপ হচ্ছে।

এগুলো দিয়ে বোঝা যায়, বড় কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্যই হলোÑযত পারা যায় মুনাফা অর্জন করা এবং যত পারা যায় ব্যয় কম করা। সেজন্য মূল্য দিতে হবে এই গ্রহ ও গ্রহে বসবাসকারী মানুষকে।

এখন আসে সবচেয়ে বড় প্রশ্নÑআমরা কীভাবে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে পারি? গ্রিনওয়াশিং ও করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা কেবলই একটি কৌশল, যার মাধ্যমে আমাদের মনোযোগ সরিয়ে রাখা যায়। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর মার্কেটিং ক্যাম্পেইন কেবল পুঁজিবাদী স্বার্থরক্ষার আরেকটি উদাহরণ। এই তো গেল সামান্য কিছু বৈশ্বিক উদাহরণ। আমাদের বাংলাদেশের দিকে তাকালেও এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আইনের প্রয়োগ এখনও আমাদের দেশে এতটা কার্যকর নয়। সর্বোপরি আমরা তো আমাদের এমন কার্যকলাপ কমানোর চেষ্টা করবই, যাতে পরিবেশের ক্ষতি হয়, কিন্তু সরকারের দায়িত্ব এখানে সবচেয়ে বেশি। কোনো কোম্পানি বা করপোরেশন যেন জনগণকে গ্রিনওয়াশ করতে না পারে, পরিবেশের ক্ষতি করে আবার বড় বড় পরিবেশ সচেতনতার বিজ্ঞাপন দিয়ে জনগণকে ধোঁকা দিতে না পারে, সে ব্যাপারে সরকার আরও বেশি মনোযোগী হবে বলেই জাতির প্রত্যাশা।

শিক্ষার্থী

ইসলামি শিক্ষা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়