ফুয়াদ হাসান: ব্যাংক ব্যবস্থা কোনো দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। দেশের অর্থনৈতিক অনুঘটকগুলোর সঠিকভাবে পরিচালোনার মূল চালিকা শক্তি হলো পর্যাপ্ত ও সুষ্ঠু অর্থিক প্রবাহ। দেশের অভ্যন্তরে সরকারি ও ব্যক্তি খাতের উদ্যোগে গড়ে ওঠা অর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেই অর্থিক প্রবাহ নিশ্চিত করে ও দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাঝে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। সুষ্ঠু ও সাবলিক ব্যাংকিং খাত দেশের অর্থনীতির অগ্রগতিকে বহু গুণ ত্বরান্বিত করে। দেশের অর্থনীতির গতি স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক রাখতে ব্যাংকিং খাতের ভুমিকা অপরিসীম। অর্থনীতির খাতগুলোর মাঝে সমন্বয় ও কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে ব্যাংকিং খাত অর্থিক প্রবাহ ঠিক রাখার মাধ্যমে সমতা নিশ্চিত করে। কোন কারণে ব্যাংকিং খাত দুর্বল হয়ে পরলে তার বিরূপ প্রভাব অর্থনীতির সব অনুষঙ্গের ওপর পরে। অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় অর্থনীতির এই অতিব গুরুত্বপূর্ণ অনুসর্গের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত ও অর্থনীতির সুষম গতি স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকিং খাতের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল হওয়া জরুরি।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য অতি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আজকে কঠিন সমীকরণের যোগ-বিয়োগ চলমান। প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা, তাত্ত্বি¡ক দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক অস্বচ্ছতা, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা ও অদূরদর্শিতাসহ নানাবিধ কারণ আমাদের অর্থনীতিতে সংকটের সৃষ্টি করছে। উচ্চমূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, অর্থের অবমূল্যায়নসহ সামস্টিক অর্থনীতির যত সংকট ব্যাংকিং খাতে তারল্য ও খেলাপি ঋণের সংকট তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। দেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে। তাত্ত্বিকভাবে ব্যাংক ব্যবস্থাকে অতি চাকচিক্য দেখানোর সুদীর্ঘ প্রচেষ্টা আমদের এই খাত নিয়ে সঠিক ধারণা থেকে বঞ্চিত করেছে। তারপরও যে টুকু তথ্যের অতিরঞ্জন প্রবাহ ছিল তা থেকেও কিঞ্চিৎ ধারণা করা যেত এ খাত ভালো নেই। খেলাপি ঋণ, রাজনীতির দুষ্টু নজরের বিরূপ প্রভাব, পরিচালনা পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতাসহ নানাবিধ সংকট আমাদের ব্যাংক খাতকে বিপাকে ফেলেছে। সংকট মোকাবিলায় দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণসহ নানাবিধ প্রচেষ্টা চালানো হলেও সমাধান অশানরূপ হয়নি; কারণ সংকট তার থেকেও বেশি প্রকট। বর্তমানে খেলাপিঋণ ও রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার যে তথ্য-উপাত্ত সামনে আসছে তা আরও ভয়াবহ বার্তা বহন করছে ব্যাংকিং খাতের জন্য। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি মারাত্মকভাবে কুলষিত। জিরো-সাম গেমের এই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জয়-পরাজয়ের সমীকরণ এতটা নোংরা ও ভয়াবহ যে ক্ষমতার পালাবদল হলে রাজনৈতিক কবি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
ফলে দেশের কল্যাণে রাজনৈতিক সাধনার অনুপস্থিতিতে ব্যক্তিস্বার্থ বেশি প্রাধান্য পায়। এজন্য আমাদের রাজনীতিতে দেশ মাতৃকার কল্যাণের বিপরীতে বেগুমপাড়ার কল্যাণ অতি লক্ষণীয়। এই সংস্কৃতি দেশে রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা সৃষ্টি করে। ফলে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান কুলষিত হয় এবং তাদের সঠিক রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে পরে। দেশের অর্থিক প্রতিষ্ঠানের তাত্ত্বিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতার যে করুণ পরিণতি আমরা পরোক্ষ করছি তা রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার জঘন্যতম উদাহরণ। দেশের অর্থনীতির প্রাণ অতি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানগুলোর আজকের যে করুণ পরিণতি তা রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির নিষ্ঠুর বলি। ব্যাংক খাত দেশের অর্থনীতির হƒদপিণ্ডের মতো কাজ করে। অতি সংবেদনশীল এই খাত জনগণের আস্থা, ভরসা ও বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিঞ্চিৎ তাত্ত্বিক ভুল প্রবাহ এ খাতে ব্যাপক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। সেখানে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে যে পরিমাণ ব্যর্থতা ও অব্যবস্থাপনার গল্প ওঠে আসছে প্রতিনিয়ত পত্র-পত্রিকায়, তা এ খাতকে স্পষ্টত অস্থাহীনতার মতো আরও সংকটে দিকে ফেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপিঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই খেলাপি।
২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা (সূত্র: বণিকবার্তা ১৮ নভেম্বর ২৪)। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ভঙ্গুরতার অশুভ ছোঁয়া সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকেই পড়েছে জনতা ও ইসলামী ব্যাংক তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। লুটপাটের আগে উভয় ব্যাংকের স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভালো ছিল। রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির ফলে এই সুস্বাস্থ্য-ই গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ব্যাংক দুটির কপালে। তথ্যমতে, জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের প্রায় ৪৮ শতাংশ। বিগত ১৫ বছরে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৮৫ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা, যা ৭ গুণ বেশি। অপর দিকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা, যা ২৭ গুণ বেশি।(সূত্র: যুগান্তর ১৮ অক্টোবর ২৪)। ব্যাংকিং খাতের এই দূরদশা একদিনের নয়, দীর্ঘদিনের এই অসম প্রবাহ নানাভাবেই তাত্ত্বিক মারপ্যাঁচে সাবলিল দেখানোর চেষ্টা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে সংকট সমাধন না হয়ে আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ দশমিক ৩৫ ট্রিলিয়ন টাকা, যা দেশের মোট ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ। যদিও প্রকৃত হিসাব অনুযায়ী এই হার ২৪ শতাংশের কাছাকাছি (সূত্র: সমকাল ১৮ নভেম্বর ২৪)। চলামান রাজনৈতিক সংকট ব্যাংকিং খাতের এই সংকটকে আরও বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করছে; যা দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক স্থিতিশিলতা, বাণিজ্যে, বহুপাক্ষিক সম্পর্ক বিকাশের পথে বাধার সৃষ্টি করছে, যা সামষ্টিক অর্থনীতির অগ্রগতির পথে বড় হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডিস, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও নানা ঝুঁকি বিবেচনা করে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান কমিয়েছে।
যা দেশের অর্থনীতি ও ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা আগের চেয়ে দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। সংস্থাটির মতে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দুর্বল অর্থনৈতিক অগ্রগতি অভ্যন্তরীণ ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশকে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর আরও নির্ভরশীল করে তুলবে। পাশপাশি সম্পদের গুণগত ঘাটতির কারণে ব্যাংক ব্যবস্থার পুঁজি ও তারল্যসংক্রান্ত দুর্বলতা বাড়িয়ে দিয়েছে (সূত্র: বণিক বার্তা ২৬ নভেম্বর ২৪)। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মাঝে ব্যাংক খাতে স্থিতিশিলতা নিশ্চিত করতে কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন রকম দিকনির্দেশনার পাশাপশি এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৭টি ব্যাংকসহ মোট ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্রষ ভেঙে পুনর্গঠন করে দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও বিচারিক স্বচ্ছতাও জরুরি এ খাতে কাক্সিক্ষত সফলতা পেতে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি আর ক্ষমতার অপ্রয়োগে ব্যাংক ধ্বংস করে ফেললেও, সেসব রাজনৈতিক মদদপুষ্ট রাঘব বোয়ালদের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। প্রচলিত আইন এ দেশের ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারী কৃষকদের জেলে পাঠাতে পারলেও। ব্যাংক তছরুফকারী এসব রাঘব বোয়াল থেকে যায় আইনের ধরাছোঁয়ার অনেক বাহিরে। ফলে রাজনৈতিক শক্তির এই অপ্রযোগ সংস্কৃতি পুনরায় নতুনরূপে অথবা নানামুখী হয়ে জেঁকে বসে এসব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো নীতিনির্ধারী প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ ও সুপারিশ ততটা ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে না।
যেহেতু দেশে একটা পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ নতুন করে আকাক্সক্ষা করার অভিপ্রায় পেয়েছে। এমতাবস্থায় দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্বের মতো সুদীর্ঘ বিষফোঁড়া উপড়ে ফেলে নতুন করে টেকসই অর্থনীতির বীজ বোপন করতে না পারলে মানুষ পুনরায় আশাহত হবে, যা উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠীর ধারণার বিপরীত। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে চলমান সংকট নিরসনে ব্যাংক খাতের গুরুত্ব অতুলনীয়। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির অনুষঙ্গের মাঝে নিরবিচ্ছিন্ন অর্থের প্রবাহ ও অর্থনীতির স্বাভাবিক কার্যক্রম নিশ্চিত করতে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশিলতা জরুরি। কিন্তু দীর্ঘদিনের অপসংস্কৃতির দায়বদ্ধতার খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে চলমান সামগ্রিক অস্থিরতা ও ব্যাংক খাতে আস্থার ঘাটতি এ সংকটকে আরও প্রকট করে তুলছে। এমতাবস্থায় সুষ্ঠু রাজনৈতিক অঙ্গীকার, প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ও তাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা প্রতিষ্ঠাপূর্বক সামনের পথ নির্ধারণ করতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুষ্ঠু প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের সুচারু নেতৃত্ব ও সামগ্রিক অংশগ্রহণই পারে দেশের ব্যাংক খাতে চলমান অস্থিরতা নিরসন করতে।