নূর হোসেন মামুন, চট্টগ্রাম : আকাশ কিংবা নদীপথ-দু’ভাবেই চট্টগ্রামে ঢোকে বিদেশ থেকে আসা পণ্য। আকাশপথে সামান্য হলেও জলপথ ধরেই দেশের সিংহভাগ আমদানি করা পণ্য আসে চট্টগ্রামে। বৈধ পন্থার পাশাপাশি অবৈধভাবেও পণ্য আসে এসব পথে। সরকারের নানা উদ্যোগ-প্রচেষ্টার পরও কোনোভাবেই থামছে না চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবৈধভাবে পণ্য আসা।
এর ফলে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। অবৈধভাবে আসা এসব পণ্যের সঙ্গে নানাভাবে বন্দর-কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট সব সেক্টরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। খোদ সরকারেরই একজন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা অবৈধভাবে আসে। কথাটিতে তিনি চাঁদাবাজিকে ইঙ্গিত করলেও এর সঙ্গে নানাভাবে সামগ্রিক অনিয়ম-দুর্নীতি বুঝানো হয়েছে বলে মনে করছেন বন্দরসংশ্লিষ্টরা।
এদিকে অবৈধভাবে আসা এসব পণ্যের সরবরাহ ঠেকাতে প্রশাসন উদ্যোগ নিলেও তা যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই অভিযান আরও বাড়ানোর তাগিদ তাদের। এদিকে গত সপ্তাহে দুটি চালান জব্দ করার ঘটনা নিয়ে দুই কাস্টমস কর্মকর্তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। গাড়ি ভেঙে তাদের গুলির চেষ্টাও করা হয়। সব মিলিয়ে এ নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে কর্মকর্তাদের মনে; তাই এই পরিস্থিতির উন্নয়নেও উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মত সরকারি চাকরিজীবীদের।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ অক্টোবর দুই কনটেইনারের একটি চালান নামানো হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। পাকিস্তান থেকে দুই কনটেইনারে আসার কথা ছিল পাখির খাদ্য। তবে কনটেইনার দুটি খুলে আমদানি-নিষিদ্ধ পপি বীজ পেয়েছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামের কোরবানীগঞ্জের মেসার্স আদিব ট্রেডিং এই চালানটি আমদানি করে। আমদানি নথিতে ৩২ টন পাখির খাদ্য আমদানির তথ্য ছিল। এরপর খালাসের জন্য বেসরকারি ডিপো ছাবের আহম্মেদ টিম্বার কোম্পানি লিমিটেডে নেওয়া হয়। তবে এরই মধ্যে গোপন সংবাদে খবর পেয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা চালানটির খালাস স্থগিত করে পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেন। সে অনুযায়ী ২২ অক্টোবর কনটেইনার দুটি খোলা হয়। উদ্ধার পণ্যের নমুনা তিনটি পরীক্ষাগারে পাঠিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা পপি বীজ সম্পর্কে নিশ্চিত হন। এতে সাত টন পাখির খাবার ও ২৫ টন পপি বীজ পাওয়া যায়। বিষয়টি গোপন রাখতে পাকিস্তানে পণ্যবোঝাই করার সময় কনটেইনার দরজার মুখে পাখির খাদ্যের বস্তা রাখা হয়। ভেতরের দিকে রাখা হয় পপি বীজ।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার এইচএম কবির বলেন, জব্দ করা পপি বীজের বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা। আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মূলত পপি বীজ অঙ্কুরোদ্গম উপযোগী হলে তা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ অনুসারে ‘ক’ শ্রেণির মাদক হিসেবে বিবেচিত। আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী, পপি বীজ আমদানি নিষিদ্ধ।
এর আগে ৩৯ টন ঘনচিনি বা সোডিয়াম সাইক্লামেটের চালান আটক হয় গত অক্টোবরে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল এসপি ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা হলো ২১৮ মিটফোর্ড রোড, বংশাল, ঢাকা। গত ৪ অক্টোবর পলিঅ্যালুনিমিয়াম ক্লোরাইড ঘোষণায় চীন থেকে তিনটি কনটেইনারে ৬৩ মেট্রিক টন পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করে। চালানটি খালাসের জন্য আমদানিকারকের পক্ষে সি বার্ড করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান গত ৭ অক্টোবর বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। পণ্যের চালানটি খালাসের জন্য ট্রাকে ওঠানোর পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তারা পণ্যের খালাস স্থগিত করেন। এরপর গত ২৮ অক্টোবর সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কায়িক পরীক্ষা করা হয় এবং পরীক্ষাকালে দুই ধরনের পণ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যার নমুনা চট্টগ্রামের কাস্টমস হাউস পরীক্ষাগারে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনে ওই দুই শ্রেণির পণ্যের মধ্যে একটিতে ২৪ টন পলিঅ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড পাওয়া গেলেও বাকি ৩৯ টন পণ্যকে ঘনচিনি হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে।
মূলত ঘনচিনি একটি কৃত্রিম মিষ্টিকারক, যা সাধারণ চিনির চেয়ে ৩০ থেকে ৫০ গুণ বেশি মিষ্টি। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, বেকারি আইটেম, আইসক্রিম, বেভারেজ, জুস, চকলেট, কনডেন্সড মিল্ক ও শিশুখাদ্য তৈরিতে সাধারণ চিনির পরিবর্তে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই ক্ষতিকারক কৃত্রিম উপাদান ব্যবহার করে থাকেন।
এর আগে গত ২১ মে চট্টগ্রাম বন্দরে কমলালেবু আমদানির ঘোষণা দিয়ে আনা কোটি টাকার বিদেশি সিগারেট জব্দ করে কাস্টমস হাউন। জব্দ এক কোটি ২৫ লাখ শলাকা ল্যামার ও অস্কার ব্র্যান্ডের সিগারেট। ঢাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আহসান করপোরেশন গত ১৫ মে চালানটি কমলালেবুর নামে ঘোষণা করে। পণ্য খালাসের দায়িত্বে ছিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট দিবা ট্রেডিং লিমিটেড।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস জানায়, চালান ঘোষণার গরমিল দেখে বিষয়টি খতিয়ে দেখে তারা। পরে ‘ফোর্সড কিপ ডাউন’ পদ্ধতিতে কনটেইনারটি পরীক্ষা করে ভেতরে পাওয়া যায় ১ হাজার ২৫০ কার্টুন ল্যামার ও অস্কার ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট এবং মাত্র ৩৮ কার্টুন ঘোষিত পণ্য ‘ফ্রেশ ন্যাভেল অরেঞ্জ’। এআইআর শাখা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, এই চালানের মাধ্যমে প্রায় ৩০ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা করা হয়েছিল।
কাস্টম হাউসের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ আল আমিন জানান, ভুয়া ঘোষণা ও নথিপত্র ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির অপচেষ্টা করা হয়েছে। আমরা তদন্ত করছিÑপুরো প্রক্রিয়া শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশে বৈধভাবে বিদেশি সিগারেট আমদানির ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে বাংলায় ধূমপানবিরোধী সতর্কবার্তা থাকা বাধ্যতামূলক। তবে জব্দ করা সিগারেটগুলোয় তা ছিল না। নিয়মানুযায়ী মান যাচাই শেষে এসব পণ্য ধ্বংস অথবা নিলামে বিক্রি করা হবে।
অন্যদিকে সম্প্রতি চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমস অ্যারাইভাল হলে ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ কর্নারের পাশ থেকে মালিকবিহীন অবস্থায় ছয়টি লাগেজ উদ্ধার করা হয়। এসব লাগেজ খোলার পর ৮০০ কার্টন সিগারেট উদ্ধার করা হয়। লাগেজগুলোর কোনো মালিক শনাক্ত না হওয়ায় নির্ধারিত প্রটোকল অনুযায়ী ব্যাগগুলো খোলা হয়। এতে পাওয়া যায় ৮০০ কার্টন বিদেশি সিগারেট; যা ব্যাগেজ রুল অনুযায়ী অনুমোদিত পরিমাণের বহুগুণ বেশি।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের মুখপাত্র মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল বলেন, নিয়ম অনুযায়ী একজন যাত্রী এক কার্টন সিগারেট আনতে পারেন, তাও বিনা শুল্কে। এর বেশি আনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সে কারণে লাগেজগুলো পরিত্যক্ত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে। আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী সিগারেট শর্তযুক্ত পণ্য। প্যাকেটে বাংলায় ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ লেখা ছাড়া সিগারেট আমদানি করা যাবে না। পরিত্যক্ত মালামাল জব্দসংক্রান্ত বিধান অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এদিকে গত কয়েক মাসে বড় অঙ্কের রাজস্ব জালিয়াতির একাধিক চেষ্টা এবং নিষিদ্ধ পণ্য আমদানি আটকে দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। এসব অভিযানে যুক্ত ছিলেন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান খান ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. বদরুল আরেফিন ভূঁইয়া। এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, এ কারণেই দুজনের ওপর ক্ষুব্ধ হয় জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত চক্রের সদস্যরা। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরের ডবলমুরিং থানার সিডিএ আবাসিক এলাকায় দুই কাস্টমস কর্মকর্তা একটি ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকারে ছিলেন। তিন ব্যক্তি মোটরসাইকেলে এসে প্রাইভেট কারটি থামান। এরপর চাপাতি দিয়ে গাড়ির কাচে কোপ দেন। গাড়ির কাচ ভাঙার পাশাপাশি হামলাকারীরা একজন আরেকজনকে বলতে থাকেন, ‘গুলি কর, গুলি কর’। তবে দুই কর্মকর্তা দ্রুত গাড়ি সরিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে আসেন।
হামলার শিকার রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান খান বলেন, তারা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। বিভিন্ন অনিয়ম ও রাজস্ব জালিয়াতি শনাক্ত করায় এ হামলা হতে পারে। ৫ অক্টোবর বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে এক ব্যক্তি ফোন করে ভয় দেখান, মেরে ফেলার হুমকি দেন। কসমেটিকসের দুটি চালান ছেড়ে দিতে বলেন। এ ঘটনায় পরদিন বন্দর থানায় একটি জিডি করেছিলাম। এ রকম নানা সময়ে হুমকি পেয়েছি।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার মো. তারেক মাহমুদ বলেন, আমদানি নিষিদ্ধ পপি বীজ ও ঘনচিনি আটক করা হয়েছে। আবার বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী আমদানিকে কেন্দ্র করে কাস্টমসে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে মালামাল আনা হচ্ছিল। গত দুই মাসে এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে কিছুদিন ধরে বিভিন্ন নম্বর থেকে মুঠোফোনে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কিছুদিন আগে একজন ফোন করে নিজেকে সাজ্জাদ পরিচয় দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেন। তবে কোন সাজ্জাদ, তা বলেননি। আমাদের ধারণা, কাস্টমসে অনিয়ম ধরার কারণেই এ হামলা হতে পারে।
এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে প্রত্যেকটি জায়গায় চাঁদাবাজি হয়। এ বন্দরে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা ইলিগালি (অবৈধভাবে) আসে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, উপদেষ্টা মহোদয় যা বলেছেন তা ঠিক আছে। সমস্যা আছে বলেলেই হবে না, এটা (চাঁদাবাজি ও অবৈধপণ্য আমদানি) বন্ধ করতে হবে সরকারকেই। এটা সমাধান করার জন্য তাদের উদ্যোগ নিতে হবে। বন্দর ইজারা দেওয়ার জন্য যেমন সবাই উঠে-পড়ে লেগেছে, তেমনি এখানে সেবার মান এবং অবৈধভাবে আমদানি করা পণ্য বন্ধ করতে হবে। আর না হয় চট্টগ্রাম বন্দরের সুনাম ক্ষুণ্ন হবে, এতে করে সেবাগ্রহীতরা বন্দর ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে। এতে আমাদেরই ক্ষতি।
প্রিন্ট করুন




Discussion about this post